ঢাকা ১১:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




‌‘বিরোধ ভাঙতে হিন্দু-মুসলিম বেশি বেশি বিয়ে হওয়া দরকার’

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:২০:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯৯ বার পড়া হয়েছে

তসলিমা নাসরিন

আমি বিশ্বাস করি জিহাদে কোনও ভালোবাসা নেই, এবং ভালোবাসায় কোনও জিহাদ নেই।

কিন্তু কিছু মুসলিম-বিরোধী লোক ‘ লাভজিহাদ’ বলে একটি শব্দ বানিয়েছে, এর মানে হচ্ছে ভালোবাসার অভিনয় করে মুসলমানরা হিন্দুদের বিয়ে করছে, এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করছে। তথকথিত এই লাভজিহাদ বন্ধ করার জন্য আইন জারি করা হচ্ছে ভারতবর্ষে।

আমি এতকাল ভাবতাম এই সেক্যুলার ভারতবর্ষে প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনও মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-নাস্তিক যা-ই হোক, যার সঙ্গে খুশি তার সঙ্গে প্রেম করবে, যাকে খুশি তাকে বিয়ে করবে — এতে কারও বলার কিছু নেই।

এতকাল ভেবেছিলাম জাতপ্রথা যে দেশে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে দেশে ব্রাহ্মণ শূদ্রকে বিয়ে করবে, শূদ্র ব্রাহ্মণকে — এতে কারও বলার কিছু নেই।

এখন দেখছি, অনেকের অনেক কিছু বলার আছে, শুধু বলার নয়, রীতিমত বলপ্রয়োগ করার আছে — উঁচু নিচু জাতে বিয়ে হতে দেবে না, হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হতে দেবে না। বিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, প্রতিবাদ করলে খুন পর্যন্ত করে ফেলা হচ্ছে।

শাহরুখ খান, আমীর খান, ইরফান খান, মনসুর আলী খান পতৌদি, সাইফ আলী খান –এঁরা বিখ্যাত লোক। বিখ্যাত লোক যদি মুসলমান হয়ে হিন্দুকে বিয়ে করে, তাতে কেউ আপত্তি করে না। ইন্দিরা বিয়ে করেছেন ফিরোজকে,
রাজীব বিয়ে করেছেন সোনিয়াকে, হিন্দু বিয়ে করেছেন পার্সিকে বা খ্রিস্টানকে, কেউ আপত্তি করেনি।

গান্ধির পুত্র বিয়ে করেছিলেন এক মুসলমান মেয়েকে, আম্বেদকার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এসব কারণে কেউ ওঁদের হুমকি দেয়নি, গ্রামছাড়া করেনি। মুশকিল হয় অখ্যাত লোক নিয়ে। তাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান ঘটলে, তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ শূদ্র ঘটলে আর রক্ষে নেই। উগ্রবাদীদের টার্গেট দরিদ্র এবং নিরীহ মানুষ। দরিদ্র আর নিরীহকে অত্যাচার করলে যেহেতু তেমন কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না, তাই করে অত্যাচার।

এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার জন্য এক মুসলমান ছেলে ধর্ম পাল্টে হিন্দু হয়েছে। হরিয়ানায় এখন তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ। ওদিকে যে হিন্দু মেয়ে ধর্ম পাল্টে মুসলমান হতে চাইছে বিয়ের জন্য — তার এবং তার মুসলমান হবু বরের ওপর ঝড় নেমে এসেছে। ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করতে হলে আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে, এমনই নতুন আইন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইলে পারবে না, ধর্মান্তরিত হতে চাইলে তাও পারবে না। গণতন্ত্র হাওয়ায় উড়ছে।

আরও পড়ুন: ‘আমরা বড় হতে থাকি অন্যকে ছোট করার অদ্ভুত শিক্ষা নিতে নিতে’

আমার মতে, সবচেয়ে ভালো, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য কাউকে বাধ্য না করা। এমন অনেক আদর্শ জুটি আছে, যারা পরস্পরকে ভালোবেসে চমৎকার যৌথ জীবন যাপন করেছে, কিন্তু যার যার ধর্ম সে সে পালন করে গেছে। এতে তাদের ভালোবাসায় কোনও চির ধরেনি।

হিন্দু মুসলমানের বিরোধ ভাঙতে হলে হিন্দু মুসলমানে বেশি বেশি বিয়ে হওয়া দরকার। আম্বেদকার জাত প্রথা ভাঙ্গার জন্য বলেছিলেন বিভিন্ন জাতের মধ্যে যত বিয়ে হবে, তত ভাঙবে জাতপ্রথা।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




‌‘বিরোধ ভাঙতে হিন্দু-মুসলিম বেশি বেশি বিয়ে হওয়া দরকার’

আপডেট সময় : ১২:২০:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

তসলিমা নাসরিন

আমি বিশ্বাস করি জিহাদে কোনও ভালোবাসা নেই, এবং ভালোবাসায় কোনও জিহাদ নেই।

কিন্তু কিছু মুসলিম-বিরোধী লোক ‘ লাভজিহাদ’ বলে একটি শব্দ বানিয়েছে, এর মানে হচ্ছে ভালোবাসার অভিনয় করে মুসলমানরা হিন্দুদের বিয়ে করছে, এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করছে। তথকথিত এই লাভজিহাদ বন্ধ করার জন্য আইন জারি করা হচ্ছে ভারতবর্ষে।

আমি এতকাল ভাবতাম এই সেক্যুলার ভারতবর্ষে প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনও মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-নাস্তিক যা-ই হোক, যার সঙ্গে খুশি তার সঙ্গে প্রেম করবে, যাকে খুশি তাকে বিয়ে করবে — এতে কারও বলার কিছু নেই।

এতকাল ভেবেছিলাম জাতপ্রথা যে দেশে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে দেশে ব্রাহ্মণ শূদ্রকে বিয়ে করবে, শূদ্র ব্রাহ্মণকে — এতে কারও বলার কিছু নেই।

এখন দেখছি, অনেকের অনেক কিছু বলার আছে, শুধু বলার নয়, রীতিমত বলপ্রয়োগ করার আছে — উঁচু নিচু জাতে বিয়ে হতে দেবে না, হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হতে দেবে না। বিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, প্রতিবাদ করলে খুন পর্যন্ত করে ফেলা হচ্ছে।

শাহরুখ খান, আমীর খান, ইরফান খান, মনসুর আলী খান পতৌদি, সাইফ আলী খান –এঁরা বিখ্যাত লোক। বিখ্যাত লোক যদি মুসলমান হয়ে হিন্দুকে বিয়ে করে, তাতে কেউ আপত্তি করে না। ইন্দিরা বিয়ে করেছেন ফিরোজকে,
রাজীব বিয়ে করেছেন সোনিয়াকে, হিন্দু বিয়ে করেছেন পার্সিকে বা খ্রিস্টানকে, কেউ আপত্তি করেনি।

গান্ধির পুত্র বিয়ে করেছিলেন এক মুসলমান মেয়েকে, আম্বেদকার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এসব কারণে কেউ ওঁদের হুমকি দেয়নি, গ্রামছাড়া করেনি। মুশকিল হয় অখ্যাত লোক নিয়ে। তাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান ঘটলে, তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ শূদ্র ঘটলে আর রক্ষে নেই। উগ্রবাদীদের টার্গেট দরিদ্র এবং নিরীহ মানুষ। দরিদ্র আর নিরীহকে অত্যাচার করলে যেহেতু তেমন কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না, তাই করে অত্যাচার।

এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার জন্য এক মুসলমান ছেলে ধর্ম পাল্টে হিন্দু হয়েছে। হরিয়ানায় এখন তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ। ওদিকে যে হিন্দু মেয়ে ধর্ম পাল্টে মুসলমান হতে চাইছে বিয়ের জন্য — তার এবং তার মুসলমান হবু বরের ওপর ঝড় নেমে এসেছে। ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করতে হলে আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে, এমনই নতুন আইন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইলে পারবে না, ধর্মান্তরিত হতে চাইলে তাও পারবে না। গণতন্ত্র হাওয়ায় উড়ছে।

আরও পড়ুন: ‘আমরা বড় হতে থাকি অন্যকে ছোট করার অদ্ভুত শিক্ষা নিতে নিতে’

আমার মতে, সবচেয়ে ভালো, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য কাউকে বাধ্য না করা। এমন অনেক আদর্শ জুটি আছে, যারা পরস্পরকে ভালোবেসে চমৎকার যৌথ জীবন যাপন করেছে, কিন্তু যার যার ধর্ম সে সে পালন করে গেছে। এতে তাদের ভালোবাসায় কোনও চির ধরেনি।

হিন্দু মুসলমানের বিরোধ ভাঙতে হলে হিন্দু মুসলমানে বেশি বেশি বিয়ে হওয়া দরকার। আম্বেদকার জাত প্রথা ভাঙ্গার জন্য বলেছিলেন বিভিন্ন জাতের মধ্যে যত বিয়ে হবে, তত ভাঙবে জাতপ্রথা।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।