বিশেষ প্রতিবেদক!! মা অসুস্থ, বাবা বৃদ্ধ। সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছে ভাইবোন সকলের বড় মাহিনুরকে। কখনো গার্মেন্টসেে চাকুরী আবার কখনো সেলাই কাজ করে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা আর বৃদ্ধ বাবাকে একটু স্বস্তি আর স্বামীহীন এ নারী তিন কন্যা সন্তানের মুখে দু'বেলা খাবার তুলে দিয়ে একটু হাসি ফুটাতে সংসারের এ বড় সন্তানটি যেন জীবন যুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষায় নেমে পড়েন। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কাজলা দনিয়া এলাকার ৭/এ নামক বাড়িটির জীর্নশীর্ন ২ রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন মাহিনুররা।
সংসারের অস্বচ্ছতার অবসান ঘটাতে মাহিনুর যেন নিজের ভবিষ্যতের কথা ভুলেই গেছেন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় গার্মেন্টসে চাকরীরকালে দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন মাহিনুর। ওই চক্রটির মূল হোতা জৈনক আলাউদ্দিন বকশী ও তার লোকদের বিভিন্ন প্রলোভনের শিকার হন সাহিনুর। এ চক্রটির প্রধান আলাউদ্দিন বকশী সাহিনুরকে বিদেশে নিয়ে বড় মাপের চাকুরী দিয়ে বেশি টাকা বেতন পাওয়ার লোভ দেখান। তার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেননা মাহিনুর। একপর্যায় সাহিনুরকে বিশ্বাস করাতে আলাউদ্দিন তার সিন্ডিকেটর সদস্য মানসুর সর্দার, জাহানঙ্গীর তালুকাদার ও ফকরুল ইসলাম সহ বেশ কয়েকজনকে মাহিনুরের সামনে হাজির করান।
তাদেরকে দিয়ে মাহিনুরকে বলানো হয় যে, তাদের বোন ও অনেক নারী আত্মীয় আলাউদ্দিন বকশীর মাধ্যমে অল্প খরচে বিদেশে গিয়ে এখন ভালো বেতন পাচ্ছেন। ঐ পরিবার গুলো অল্প দিনেই কোটিপতি হয়ে গেছেন। বিদেশে নারী পাচারচক্রটির নানা প্রলোভনমূলক কথা গুলো সরল মনে বিশ্বাস না করে পারেননি মাহিনুর। মাহিনুরের পরিবারে পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদককে জানানো হয় দালালচক্রের মূল হোতা আলাউদ্দিন বকশী মাহিনুরকে সৌদিআরব নিবে বলে বিভিন্ন সময় তাদের পাঁচ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেন। একপর্যায়ে অনেক ঘুরাঘুরি পর একটি এজেন্সির মাধ্যমে মাত্র ত্রিশদিনের মেয়াদে ভিসা নিয়ে মাহিনুরকে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। বলা হয়, সৌদিআরব যেতে হলে মালয়েশিয়ায় একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে। এ জন্যই সেখানে পাঠাচ্ছি।
তাদের কথা মত চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি মাহিনুর পাড়িজমান মালয়েশিয়ায়। মাহিনুর জানান, প্লেন থেকে নামার পরপরই একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস এসে এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নিয়ে যায়। একটি বিল্ডিং এর ফ্ল্যাটে তাকে উঠানো হয়। মাহিনুর সেখানে গিয়ে দেখতে পান আরো বহু বাঙালী নারী রয়েছে। যাদের উপর চালানো হচ্ছে যৌন নিপীড়ন। নিরুপায় মাহিনুর সেখানে প্রায় পাঁচদিন বন্দি ছিলেন।
ঐ সময়ের বিভৎসদিন গুলোর কথা বলতে গিয়ে মাহিনুর কান্নায় ভেঙে পড়েন। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর মাহিনুর জানতে পারেন তাকে বাংলাদেশ থেকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। সেখান তার উপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চলছিল বলে এই প্রতিবেদককে জানানো হয়। এভাবে পাঁচদিন অতিবাহিত হলে সাহিনুর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাদিন অবস্থায় মাহিনুর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশি এক ব্যক্তির সহযোগীতা নিয়ে হাই কমিশনের আশ্রয়ে এ বছরের ২১ জানুয়ারি পাচারকারীদের বন্দিদশা থেকে অবশেষ দেশের মাটিতে ফিরে আসেন সেই সাহিনুর। দেশে ফিরার পর দালালচক্রটিকে খুঁজে বের করলেও মাহিনুর ফিরত পাননি তার পাঁচ লক্ষাধিক টাকা। রক্ষা করতে পারেননি নিজের সম্ভ্রম। এদিকে মাহিনুর জানান, দেশে ফিরার পর গত দশ মাস যাবৎ মানব পাচারকারী দালালচক্রটি তাকে অপহরণে চেষ্টা চালাচ্ছে। আলাউদ্দিন বকশী গুন্ডাবাহিনী তাকে বাসায় গিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে।
ফলে ঘর ছেড়ে মাহিনুর এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমান মাহিনুর ও তার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান। সাহিনুরকে নিয়ে তার পরিবার এখন চরম আতংক, উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় রয়েছেন। মাহিনুর জানান আমি জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে উক্ত বিষয়টি আমি আইনের কাছে যেতে সাহস করিনি। কিন্তু সকলের সহযোগীতা পেলে এ সকল পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করতে পারবেন বলে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন নির্যাতিতা মাহিনুর।