ফিচার ডেস্ক;
কুমিল্লা শহরজুড়ে মানুষ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি নামকে এখন নিজেদের মনে করে, সংগঠনটির নাম ‘জাগ্রত মানবিকতা’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক তাহসীন বাহার সূচনা। তার মানবিকতার গল্প শোনাচ্ছেন বেনজির আবরার-
কোনো ধরনের অনুদান ছাড়াই সংগঠনটি প্রতিবছর মেডিক্যাল ক্যাম্প, ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের মাধ্যমে পুরো কুমিল্লায় সাড়ে ৪ হাজার রক্তদান, পুরো শহরে ডেঙ্গুরোগের প্রতিষেধক, করোনায় ২০ হাজারের বেশি অসহায় পরিবারকে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করেছে। তাহসীন তার বাবার উদ্যোগে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে কাজগুলো করেন। এ ছাড়া বড় কয়েকটি কাজ অনেকটা অগোচরেই করে গেছেন।
কুমিল্লার এ মেয়ে পেয়েছেন তার পিতা কুমিল্লা-৬ আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের নেতৃত্বগুণের পুরোটাই। বাবা শহরের জনপ্রিয় মানুষ হলেও তাহসীন চেয়েছেন বাবার কাজের সহযোগী হতে নিজের মত কিছু করে। তার বাবা কুমিল্লা পৌরসভার দুইবারের মেয়র ছিলেন, এখন এমপি। এমপি পরিবারের এ বড় মেয়ে পেশায় নাইস আইটি অ্যান্ড সলিউশন্সের পরিচালক।
থেকেছেন ঢাকার উত্তরায়। পড়েছেন কুমিল্লা মিশনারী স্কুল, কুমিল্লা উইমেন্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক। এরপর উত্তরার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়েছেন। এরপর শুরু করেছেন জাগ্রত মানবিকতার কাজ। বাবাকে যখন একজন বললেন, ‘আপনার মেয়ে এমবিবিএস পাস। আপনার জীবনে তো আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।’ বাবা বলেছেন, ‘দোয়া করো যাতে মানুষ হয়। ভালো মানুষ না হলে লাভ হবে না।’
বাবার পরিচিতিতে চাইলেই নিজের হাসপাতাল নিয়ে বসতে পারতেন, চিন্তামুক্ত জীবন নিয়ে। কিন্তু না, বাবাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পেলেন নিজের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জাগ্রত মানবিকতায়। মা মেহেরুন্নেসা বাহার সংগঠনটির সভাপতি।
পরিবারকে সাথে নিয়ে চলার এ সময়ে একজন মানুষের কথা না বললেই নয়। কুমিল্লার তারুণ্যের প্রিয় একজন মানুষ সাইফুল ইসলাম রনি। তিনি তাহসীনের স্বামী। তবে এরচেয়ে বড় যদি বলা হয়, তাহসীনের সব কাজের প্রধান সহায়ক শক্তি।
কুমিল্লা শহরের ২৭টি ওয়ার্ডের পাশাপাশি জেলার ১৬টি উপজেলায় জাগ্রত মানবিকতা কাজ করছে নিয়মিত। জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে তাদের কাজ। প্রতিনিয়ত তরুণ-তরুণীরা যুক্ত হচ্ছেন এ প্লাটফর্মে।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠন গত রমজানেই প্রতিদিন ইফতার আর সাহরি করিয়েছে পথের মানুষদের। শহরের আশ্রম, এতিমখানা, মাদ্রাসায় তাদের সহযোগিতা নিয়মিতই যায়। করোনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য বাবার ফোন ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের খাবার পাঠিয়েছেন। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো মানুষের খাদ্য ও পাঁচ হাজার অস্বচ্ছল মানুষের পনেরো দিনের খাবার দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া অক্সিজেন ব্যাংক ও প্লাজমা সহায়তা তো রয়েছেই।
এ পর্যন্ত তারা ছয়জন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের পুরো খরচ বহন করেছেন ফান্ড থেকে। এরমধ্যে ক্যান্সারের ২ জন, হার্টের ২ জন, টিউমার নিয়ে থাকা ২ জন রয়েছেন। সার্জারির দায়িত্বই তারা নিয়েছেন ছয় জনের। এ কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন মানুষের জীবনের গল্প তার চোখে ভাসে। তাহসীন বলেন, ‘মানুষের জীবনের গল্প একেক রকম। আমরা নাঙ্গলকোটের একটা ছেলের সন্ধান পেয়েছিলাম, নাম রবিউল। ওর প্রতিবন্ধী জীবনে চিকিৎসা দিতে আমরা ওর পুরো খরচ হাসপাতালে রেখে বহন করি।’
তিনি বলেন, ‘ছেলেটিকে যখন আমি দেখতে যাই ও বলে ওঠে, ‘আপনি আছেন তাই আমি ভয় পাই না।’ এরকম নানা গল্প আমার চোখে এসেছে গত কয়েকবছর জাগ্রত মানবিকতার কাজ করতে গিয়ে। স্বপ্ন দেখি আমাদের কুমিল্লার মানুষের দুঃখগুলো অন্তত আমার পর্যন্ত আসুক। সব মোচন না করতে পারি, জানলে হয়তো চেষ্টা তো করতে পারবো।’
নারীর জন্য তারা ফ্রি অ্যাডভোকেসি, তাদের পাশে দাঁড়ানোর আয়োজন আর সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে তাদের সেমিনারের মাধ্যমেও উৎসাহিত করেছেন তারা।
তাহসীন বাহার বলেন, ‘জাগ্রত মানবিকতার মূল পর্ষদ ১২ জনের হলেও আমাদের সদস্য সংখ্যা মানে স্বেচ্ছাসেবী জেলাজুড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। আমরা কাজ করি মানবিক সমাজ গঠনে। আমি স্বপ্ন দেখি, একজনও হাত পাতবে না মানুষের কাছে। রক্তদানের ক্যাম্পেইনে আমাদের শিরোনাম স্বেচ্ছায় রক্তদান, বাঁচুক মানবপ্রাণ। আমরা এতে প্রতিপাদ্য দিয়েছিলাম, ‘শুভ চেতনার ধমনী কখনো রক্তশূন্য হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছাসেবীদের বোঝাতে পেরেছি, কী লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। যেহেতু নিজেরা অনুদান চাই না। কেউ একদম নিজের ইচ্ছায় দিতে চাইলে, তাকে আমাদের ইভেন্টে এসে নিজহাতে সেবা দিতে বলি, সহায়তা দিতে বলি। তাই সবার জাগ্রত মানবিকতা সবার জন্য।’