নিজস্ব প্রতিবেদক:
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম চৌধুরী। সরকারপ্রধান ছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা দেশের একমাত্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। তিনিই ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রশাসনিক অভিভাবক। ১৫ আগস্টের দিনটি তার কেটেছিল উদ্বেগ আর হতাশায়।
তার বর্ণনায় সেদিনের ঘটনা উঠে এসেছে এভাবে, “তখনো পুরোপুরি ভোর হয়নি। আমার স্ত্রী গোলাগুলির শব্দ শুনে আমাকে জাগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘কী যেন ঘটেছে।’ হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আমি একটু স্বাভাবিক হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কিসের শব্দ, কোন দিক থেকে আসছে। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। আমি চমকে উঠি! ফোন উঠিয়েই ওপারে শুনতে পেলাম উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কণ্ঠস্বর। আমাকে বরাবর চৌধুরী সাহেব বলে ডাকতেন তিনি।”
“উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘চৌধুরী সাহেব, বঙ্গবন্ধুর বাসায় কী হয়েছে? আপনি জানেন কিছু?’ আমি বললাম, ‘না’। ‘বঙ্গবন্ধুকে নাকি হত্যা করা হয়েছে! আপনি আপনার বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত জানান।’ এ কথা বলেই ফোন রেখে দিলেন তিনি।”
“আমি দ্রুত লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করলাম। টেলিফোনের শব্দ হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমার ছিল সরাসরি যোগাযোগের বিশেষ টেলিফোন। আমি সেই টেলিফোনে প্রথমে সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বললাম।”
“টেলিফোন ধরেই জেনারেল সফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে! সামরিক বাহিনীর কিছু বিদ্রোহী সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাসায় ট্যাঙ্ক নিয়ে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কিন্তু কিছু করার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।’
“আমি বললাম, ‘আপনি অন্যান্য বাহিনী প্রধানকে নিয়ে কী করছেন? আপনি কি বিদ্রোহ নির্মূল করবেন না? বিদ্রোহ নির্মূল করুন।’ সফিউল্লাহ আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘আধঘণ্টার মধ্যেই বিদ্রোহ নির্মূল করব। অন্য দুই বাহিনীর প্রধানের সঙ্গেও আলোচনা করেছি’।”
“জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলার পর উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলি। আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘স্যার চিন্তা করবেন না, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্রোহ নির্মূল হয়ে যাবে’।”
“এর পরপরই আমি যোগাযোগ করি মন্ত্রী আবদুল মোমেন সাহেবের সঙ্গে। আমার আশ্বাসবাণী শুনে তিনি বললেন, ‘কোথায় আছেন, আপনার বাহিনীর প্রধানগণ খুনিদের দ্বারা মনোনীত প্রেসিডেন্ট মোশতাকের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছে’!”
“আমি তেমন রেডিও শুনতাম না। সেদিনও আমার শোনা হয়নি। মোমেন সাহেবের কথায় সন্দেহ হওয়ায় আমি সামরিক দফতরে যোগাযোগ করি। আমার কথা হয় ডিজিএফআই (সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে।”
“তারা আমাকে বললেন, ‘খুনিরা ডালিমের নেতৃত্বে এসে চিফকে নিয়ে গেছে। সফিউল্লাহ সাহেব প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু জেনারেল জিয়া ও অন্য আরও দু’জনের পরামর্শে তিনি অন্য প্রধানগণের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। জেনারেল জিয়া নাকি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যখন নেই তখন দুঃখ করে কী হবে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমাদের যাওয়া উচিত।’ এ কথা শোনার পর আমি রেডিও খুলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা শুনতে পাই। আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি!”
“এসব খবর শোনার পর আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করি। বের হতে গিয়ে দেখি বাইরের গেট বন্ধ। সেনাবাহিনীর যারা আমার নিরাপত্তার জন্য বাসায় মোতায়েন ছিল, তারা আমাকে বলল, ‘ক্ষমা করবেন স্যার, এ বাসার কাউকে বের হতে দিলে শেখ সাহেবের মতো আমাদের পরিণতি ঘটবে’।”
“এ ঘটনায় আমি ও আমার পরিবারের লোকজন ভয় পেয়ে মানসিকভাবে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সারাদিন আর বাসা থেকে বের হতে পারেনি। আতঙ্কে ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় থাকতে হয়। এমনকি সাংসারিক বাজার করার জন্য কাজের লোককেও বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে আমি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের লোকজন এবং অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছি লাল টেলিফোনের মাধ্যমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার লাল টেলিফোন ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের বিশেষ টেলিফোন লাইনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। তবে নিচতলায় আমার বাসার অফিসের সাধারণ টেলিফোন লাইন চালু ছিল।”
“১৫ আগস্ট বিকেলে আমি ভীত আর চিন্তিত হয়ে বসে আছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। এমন সময় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমার বাসা ঘেরাও করে। ভেতরে প্রবেশ করে আমার খোঁজখবর নিতে নিতে তারা দোতলার দিকে উঠতে থাকে। আমি সিঁড়িতেই তাদের মুখোমুখি হই। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আমাকে নিচে আসতে বাধা দিচ্ছিল। আমি তাদের বললাম, ‘কোনো লাভ নেই, এতে সবার জীবন বিপন্ন হতে পারে।’ আমি সিঁড়ির নিচের দিকে সৈন্যদের পাশাপাশি বেসামরিক পোশাকে একজনকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘স্যার, ভয় নাই, নিচে নেমে আসুন, কথা আছে’।”
“নিচে নেমে আসতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনাকে বঙ্গভবনে যেতে হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ তিনি বললেন, ‘সামরিক বাহিনী ও প্রেসিডেন্টের নির্দেশ।’ তিনি আমাকে একটি তালিকা দেখিয়ে কয়েকজন মন্ত্রীর নাম দেখালেন, যাদের সবাইকে তিনি বঙ্গভবনে নিয়ে যাবেন। তখন আমার পরনে ছিল লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী। বেসামরিক পোশাকধারী লোকটির সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম তখন সৈন্যরা আমাকে ঘিরে ছিল। আমি পোশাক পাল্টানোর কথা বলতেই তিনি সামরিক বাহিনীর লোকজনের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কথা বললেন। দুজন সৈন্যসহ তারা আমাকে ওপরে যাওয়ার অনুমতি দিল। দুজন সৈন্য আমার সঙ্গে শোবার ঘর পর্যন্ত গেল। আমি লুঙ্গি বদলে একটি পায়জামা পরে নিলাম। ততক্ষণে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। বেসামরিক কর্মকর্তা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আপনার কোনো ক্ষতি করা হবে না। বঙ্গভবন থেকে আবার ফিরে আসতে পারবেন’।”
“তালিকা অনুযায়ী যাদের বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে তাদের মধ্যে সোহরাব সাহেব ও আলতাফ হোসেন ছিলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়েই সেনাবাহিনীর গাড়ি এ দুজনের বাসায় গেল। কিন্তু তাদের দুজনের কাউকেই বাসায় পাওয়া গেল না। এরপর আমরা গেলাম অধ্যাপক ইউসুফ আলীর বাসায়। আমি গাড়িতে বসে। কিছুক্ষণ পর ইউসুফ আলীকে নিয়ে আসা হলো। তখন তিনি আমাকে গাড়িতে দেখে বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, ফিরে আসতে পারব তো?’ আমি বললাম, ‘জানি না।’ তার পরিবারের লোকজন ততক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তিনি জমজম কূপের পানি পান করে কাবা শরিফের গিলাফের একটি টুকরো আমার ও তার মাথায় স্পর্শ করালেন। আমরা রওনা দিলাম বঙ্গভবনের দিকে।”
“বঙ্গভবনে পৌঁছানোর পর দেখি কালো পোশাকধারী সশস্ত্র লোকজন পুরো বঙ্গভবন ঘিরে রেখেছে। এই কালো পোশাকধারীদের মধ্যে সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যদের পাশাপাশি ছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরাও। শপথগ্রহণ শেষে বঙ্গভবনে মোশতাক সাহেব সবাইকে ডেকে বললেন, ‘শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। আপনারা কেউ যাবেন?’ উপস্থিত সবাই চুপ। কিছুক্ষণ পর আবদুল মান্নান সাহেব বললেন, ‘আপনি কি সত্যি এ কথা বলছেন, আপনি কি তা-ই চান?’ খন্দকার মোশতাক চুপ হয়ে গেলেন। সবাই অন্য রুমে চলে যাওয়ার পর আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন মোশতাক। আমাকে বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি মুজিবের খুব প্রিয় লোক ছিলে, তা না হলে কী করে তোমাকে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী করল। সরকারের প্রধান ছাড়া আর কারও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। কাল থেকে তোমার দফতর হবে শিল্প, আগেও ছিল। প্রতিরক্ষার দায়িত্ব শুধু আমার’।”
“শপথ গ্রহণের পর কথা হলো জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন, ‘বিদ্রোহ দমন নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে তা কাউকে জানাইনি। বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু অবস্থার পরিপেক্ষিতে কিছুই করতে পারিনি।’ সফিউল্লাহ সাহেব তখন তার গলায় সব সময় একটা ছোট কোরআন শরিফ ঝুলিয়ে রাখতেন। কোরআন শরিফটি আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি’।”
(তথ্য সূত্র : বেলা-অবেলা, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ)