হাফিজুর রহমান শফিকঃ-
*পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করেই রাজধানীর ফুটপাতে চাঁদাবাজি কারবার
*ঈদ সহ বিভিন্ন মৌসুমে আরও বেপরোয়া হয় হকার, অকার্যকর হয় প্রশাসনিক ব্যাবস্থা
*প্রভাবশালী রাজনীতি নেতাদের প্রশ্রয়ে পাঁচশত চাঁদাবাজ সক্রিয়
*প্রতি মাসে ফুটপাত থেকে আদায় হয় আড়াই'শ কোটি টাকা
দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানীর ফুটপাতের চাঁদাবাজরা। সেই সাথে বাড়ছে ফুটপাতের পসরার পরিধি। প্রতিটি এলাকায় দৈনিক চাঁদার হার দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে দুই সিটি করপোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি কখনো।
সকালের সংবাদের দীর্ঘদিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে চার শতাধিক ব্যক্তি এই চাঁদা তুলছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক দলের নেতা, সন্ত্রাসীসহ অর্ধশত ব্যক্তি। প্রতিটি এলাকায়ই পুলিশের নামেও তোলা হচ্ছে চাঁদা। ফুটপাতে আগে থেকে ব্যবসা করে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাঁদার পরিমাণ দুই তিন গুন বাড়ছে এখন। কয়েকটি এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে তালিকা ভুক্ত সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চাঁদাবাজদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে ফের জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজিতে। ফলে যথাযথ আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ফুটপাত দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করে জানা যায়, প্রতিমাসে রাজধানীর সব এলাকার ফুটপাত থেকেই প্রায় ৩ শ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয় বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম সকালের সংবাদকে বলেন, রাজধানীতে এক লাখ ১০ হাজারের মতো হকার আছে। ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দিনে চাঁদা দিতে হয়। কোন পার্বণকে ঘিরে হকার বসানোর সংখ্যা দ্বিগুণ তিনগুন হয়ে যায়। আর এভাবে হকারদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় মাসে আড়াই শ কোটি টাকা।
এসব অনিয়ন্ত্রিত চাঁদাবাজি ও দলীয় নেতাদের কন্ট্রোলে থাকা ফুটপাত বানিজ্য বন্ধ করে যদি হকার দের নিবন্ধন করে সরকার নিজ উদ্যোগে ফুটপাতের ইজারা আদায় করতো তবে প্রতি মাসে প্রায় তিনশ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো।
তিনি আরো বলেন, পুলিশ এদেরকে গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে এসে তারা ফের চাঁদাবাজি শুরু করেছে। দুই সিটি করপোরেশন যদি প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিত, তাহলে এমন অবস্থা হতো না।
জানা গেছে, শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন গডফাদার গুলিস্তানে চার, মতিঝিলে তিন, সদরঘাটে তিন, নিউ মার্কেটে তিন, ফার্মগেটে তিন, মিরপুর ১ নম্বরে দুই, ১০ নম্বরে দুই, উত্তরায় দুই, বাড্ডায় দুই, কুড়িলে দুজন, রাজধানীর ভাটারা থানায় রয়েছে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। ফুটপাত থেকে চাঁদা তুলছে এমন ৪০০ ব্যক্তি, যাদের বলা হয় লাইনম্যান। এসব লাইনম্যানদের মুলত থানা পুলিশ অঘোষিত নিয়োগ দিয়ে থাকে তারাই চাঁদা আদায় করে পুলিশ, এলাকার সকল নেতা, এমনকি কথিত সাংবাদিকদের ভাগ বাটয়ারা করে দেয়।
ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের এক ব্যবসায়ী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সকালের সংবাদকে বলেন, মিরপুর রোডের ধানমণ্ডি ও নিউ মার্কেট অংশে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার চাঁদা তোলে। সারা বছর এদের উৎপাত তো আছেই, ঈদ পার্বণের সময় এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এদের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভ নেই ।
গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মিরপুর শাহ আলী, ১ নম্বর, গুলশান-১ ও ২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার, মুক্তবাংলা, উত্তরা, টংগি ও পুরান ঢাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীরাও একই রকম তথ্য দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশের সোর্স বলেন, রাজধানীতে এই চাঁদাবাজির জন্য অনেক খুন ও গুম সংগঠিত হয় যা কখনও প্রকাশ হয় না।
কয়েকটি এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা তোলা হয়। খিলগাঁওয়ের জিসান, মিরপুরের শাহাদাত ও লিটু, কারওয়ান বাজারের আশিক, কল্যাণপুরের বিকাশ-প্রকাশ, বাড্ডার মেহেদী, মগবাজারের রনি, আদাবরের নবী, মোহাম্মদপুরের কালা মনির, শাহ আলীর গাজী সুমন, পল্লবীর মোক্তার, কাফরুলের শাহীন সিকদার, যাত্রাবাড়ীতে ইটালি নাসির, জুরাইনের কচির নাম ব্যবহার করছে চাঁদাবাজ চক্র। বাড্ডা এলাকায় ডালিম, রবিন, ভাগ্নে ফারুক, আরিফ, মান্নান, রমজান, দুলাল, মানিক, সিপলু, রায়হান, রুবেল, রিয়াদ; রামপুরায় কালা পলাশ ও মুরাদ; গুলশান-বনানীতে টিপু, মহাখালীতে অপু, মিলন ও জামাই মুকুল; সাততলা বস্তিতে মনির ও লম্বু সেলিম; খিলগাঁওয়ে খালেদ ও মানিক; যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদে জাহাঙ্গীর ও সায়েম আলী; হাজারীবাগে বুলু, লিংকন, তপু, জনি, রফিক, বিল্লু ও মুন্না; কলাবাগানে নাজিম বাবু ও ইমন; মোহাম্মদপুরে গালকাটা মোশারফ, লম্বা মোশারফ, চিকা জসিম, আহম্মদ, সাজ্জাদ, মোহন, পাভেল, লোটন, চায়নিজ তানভীর, রবিন, আদিত, মীম, খলিল ও হাজী আক্কাস এবং শাহ আলীতে বল্টু রাসেল, মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরে কালাচান ও কিলার বুলবুল গুলশান ভাটারা খন্দকার বংশের প্রশ্রয়ে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও সকল এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বিচ্ছিন্ন অনেক চাঁদাবাজ। এদের চাঁদা না দিয়ে কেউ ফুটপাতে ব্যবসা করতে পারে না।
ফুটপাত-সড়কে অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মতিঝিল, পল্টন ও শাহবাগ থানায় ৭২ চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সামছুল আলম। মতিঝিল থানার মামলায় গত বছরের ১০ জুলাই দুজনকে অব্যাহতি দিয়ে ১৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে পুলিশ। চার আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করলেও তারা সবাই জামিনে। ওই মামলার প্রধান আসামি সাইফুল ইসলাম মোল্লা এখন বহাল তবিয়তে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পাশের মার্কেটে চাঁদা আদায় করছে তার সহযোগী শিবলু ও শাহজাহান মৃধা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বায়তুল মোকাররম জিপিও লিংক রোডে হলিডে মার্কেটে খোকন মজুমদার, আবুল হাসেম, মজিবর, পোটল, নসু, হারুন অর রশীদ ও তার সহযোগীরা; উত্তরগেট এলাকায় দুম্বা রহিম, সাজু চাঁদা তুলছে। শাপলা চত্বরে আরিফ চৌধুরী; পল্টনে দুলাল মিয়া ও তার সহযোগী; গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্স ও রাস্তায় আমিন মিয়া, সাহিদ ও লম্বা হারুন; জুতাপট্টিতে সালেক; গোলাপশাহ মাজারের পূর্ব-দক্ষিণ অংশে ঘাউড়া বাবুল ও শাহীন টাকা তুলছে।
ওসমানী উদ্যানের পূর্ব ও উত্তর অংশে লম্বা শাজাহান; গুলিস্তান খদ্দর মার্কেটের পশ্চিমে কাদের ও উত্তরে হান্নান, পূর্বে সালাম, আক্তার ও জাহাঙ্গীর; গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তায় লাইনম্যান সর্দার বাবুল; সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তায় জজ মিয়া, পূর্ব পাশের রাস্তায় সেলিম মিয়া; মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে মো. আলী, আবদুল গফুর ও বাবুল ভুঁইয়া; শাহবাগে ফজর আলী, আকাশ, কালাম ও নুর ইসলাম; যাত্রাবাড়ীতে সোনামিয়া, তোরাব আলী, মান্নান টাকা তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। জুরাইন-পোস্তগোলায় খায়রুল, সিরাজ তালুকদার ও গরু হানিফ; লালবাগে আবদুস সামাদ, চানমিয়া ও ফিরোজ; মিরপুরে-১-এ ছোট জুয়েল, আলী, বাদশা ও মিজান; মিরপর-১১-এ আবদুল ওয়াদুদ, শফিক ও হানিফ; গুলশানে হাকিম আলী; কুড়িলে আবদুর রহীম ও নুরুল আমিন; এয়ারপোর্টে আকতার, মনির, ইব্রাহিম, জামাল ও বাবুল; উত্তরায় টিপু, নাসির ও হামিদ।
গুলিস্তানের লাইনম্যান জজমিয়া দাবি করেন, এক হাজার টাকা তুললে আমাকে দেওয়া হয় ২০০ টাকা। পুলিশ নেয় ৫০০, নেতারা পান ৩০০ টাকা। প্রতি রাতে থানার ক্যাশিয়ার এসে ভাগের টাকা নিয়ে যায়। আর থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ তবে কোনো নেতার নাম জানাতে রাজি হননি তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) সকালের সংবাদকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের অব্যাহত অভিযানের কারণে ফুটপাতের চাঁদাবাজরা এখন অনেকটাই কোণঠাসা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে। রমজান ও ঈদ সামনে রেখে যেন চাঁদাবাজি না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছি। টহল পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
ডিএসসিসির সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা সকালের সংবাদকে বলেন, হকার পুনর্বাসন ও তাদের সমস্যার সমাধানে এরই মধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ফুটপাতে হকারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছিল। ফুটপাত-রাস্তায় পথচারীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।