ঢাকা ১২:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




পরিবার স্কুল থেকেই শুরু হোক নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন -এম. এ. আলিম খান

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৩৭:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ ১৮৪ বার পড়া হয়েছে

এম. এ. আলিম খানঃ

“জাপানের রাজধানী টোকিওর উত্তরপূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ও বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নিক্কো পর্যটন কেন্দ্র। নিক্কো তোশোগু শ্রাইনের তিন বিজ্ঞ বানরের একটি ভাস্কর্য আছে। ৩টি বানরের একটি নিজের চোখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ জিনিস দেখব না, দ্বিতীয়টি মুখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা বলবো না এবং তৃতীয় বানরটি কানের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা শুনবো না। পরিবার এবং স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই শুরু হোক নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন। শিক্ষার লক্ষ্য হোক সত্যিকারের মানুষ হওয়া।”
নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিনদিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনা বা সামান্য স্বার্থের জন্য কত মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। নৈতিক বা অনৈতিক যেভাবেই হোক আমরা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া। দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার লাগাম না টানলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে। তবে আমরা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছি। নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কাজ শুরু করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয়ের আকস্মিক স্কুল পরিদর্শন আমাদের আশান্বিত করছে। ইতোমধ্যে স্কুলে প্রাত্যহিক সমাবেশে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দুইটি নৈতিকবাক্য পাঠ করানোর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সব স্কুলে চিঠি দেয়া হয়েছে। সরকারকেও এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে। আমরা প্রত্যশা করি, দুর্নীতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
“সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।” কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘আমার পণ’ কবিতার এই লাইনগুলো অন্তরে ধারণ করা লোকের সমাজে আজ বড় অভাব। আমাদের পাঠ্যবই খুবই সমৃদ্ধ ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য আদর্শগুণাবলী অর্জনের জন্য যথেষ্ট তার পরও কেন জানি কোথায় গলদ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. আতিউর রহমানের মতে, “মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ যেমন- শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার বাণিজ্যিক প্রবণতা ও কাঠামোগত ত্রুটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ত্বরান্বিত করছে।”
সমাজকাঠামোর অবিচ্ছেদ্য একটি উপাদান মূল্যবোধ যা সামাজিক আচার আচরণের সমষ্টি। ফ্রাঙ্কেল এর মতে, “মূল্যবোধ হলো আবেগ ও আদর্শগত ঐক্যের বোধ।” মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যবোধ। নৈতিকতার ও মূল্যবোধ অর্জনের প্রধান উৎস পরিবার। শিশুকাল থেকে মূল্যবোধের বিকাশ শুরু হয়। মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়তে ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও বাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকায় কয়েকজন ব্যক্তি মিলে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট ও বুয়েটের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. ইকবাল মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার এ. এম.এম. খায়রুল বাশার। আমরা এখন বিভিন্ন স্কুলে যে ‘সততা স্টোর’ বা অনেস্টি শপ দেখছি এটা প্রথম ২০১৬ সালে বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা উক্ত সততা স্টোর ৫বার পরিদর্শন করেন। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে দুদক মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ৫টি করে মোট ১০টি স্কুলে ‘সততা স্টোর’চালু করে। সততা স্টোরের সফলতা পর্যালোচনা দুদক দেশের বিভিন্ন উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’চালু করতে উৎসাহিত করছে। দুদকের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৫,১২৯টি ‘সততা সংঘ’এবং ৮২৪টি ‘সততা স্টোর’ রয়েছে।
বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো ‘পরিদর্শক বিহীন পরীক্ষা’। নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিবেন কিন্তু কোন পরিদর্শক থাকবে না। পরীক্ষার আগে শিক্ষকরা খাতা ও প্রশ্নপত্র রেখে দিবেন। পরীক্ষা শুরুর আগে ঘন্টা পড়লে শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে নির্ধারিত আসনে বসবেন। যথাসময়ে ঘন্টা পড়লে শিক্ষার্থীরা লেখা শুরু করবে। পরীক্ষা শুরুর ৩০মিনিট পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একজন শিক্ষক আসবেন এবং প্রশ্নপত্রে কোন ভুল থাকলে তা সংশোধন করে দিবেন। পরীক্ষা শেষের ১৫ মিনিট পূর্বে সতর্ক ঘন্টা দেয়া হয়। চূড়ান্ত ঘন্টা পড়লে শিক্ষার্থীরা লেখা বন্ধ করে নিজ আসনে বসে থাকবে। সংশ্লিষ্ট কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক উত্তরপত্র বুঝে নেয়ার পর শিক্ষার্থীরা আবার সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরীক্ষার হলের বাইরে চলে যাবেন। বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট অ্যাডাম গ্রান্ট যিনি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা করেছেন কীভাবে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা বৃদ্ধি করা যায়। তিনি শিশুদের নৈতিকতা বৃদ্ধির জন্য অভিভাবকদের ৩টি পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রশংসা এবং পুরস্কার: শিশুর বয়স ২ বছরের পর থেকে ভাল মন্দ বুঝতে শেখে। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল এটা বুঝতে শেখে। আপনি যদি আপনার শিশুর মধ্যে অপরের জন্য সমবেদনা বা সহানুভূতি তৈরি করতে চান তাহলে তার কাজের প্রশংসা করুন। সে একটি ভাল কাজের জন্য প্রশংসা পেলে পরবর্তিতে আরও ভাল কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে।
ভাষা প্রয়োগে কৌশলী হওয়া: শিশুর নৈতিক আচরণ বৃদ্ধি করতে তার প্রশংসা করার সময় ভাষা প্রয়োগে আপনাকে কৌশলী হতে হবে। ধরুন আপনার শিশু তার খেলনা কারও সাথে শেয়ার করলো, নিজের চকলেট থেকে ছোট ভাই-বোনকে দিল। তখন তাকে আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘বাহ তুমি তোমার খেলনাটি শেয়ার করে খুব ভাল একটা কাজ করেছো। কিন্তু গবেষণা বলছে আপনি যদি বলেন, ‘বাহ, তুমিতো খুব শেয়ারিং’ তাহলে পরবর্তীতে শিশু আবারও কোন জিনিস শেয়ার করতে আগের চেয়ে উৎসাহ পাবে বেশি। এখানে আপনি যেটা করছেন তা হলো আপনি তার ভাল কাজের প্রশংসা না করে ভাল চরিত্রের প্রশংসা করলেন। ‘প্রতারণা করো না’ না বলে তাকে বলুন ‘প্রতারক হয়ো না’। ঠিক একইভাবে আপনি শিশুকে আপনার কোন কাজে সাহায্য করতে বলতে চান, তাহলে ‘তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? এটি না বলে বলুন, ‘তুমি কি সাহায্যকারী হতে পারবে একটু?’ এখানে যে বিষয়টি হচ্ছে তা হল শিশু যখন তার চরিত্রের সাথে ভাল গুণগুলো যোগ হতে দেখে তখন সে আরও বেশি উৎসাহিত হয় ভাল কাজটি আবার করতে।
লজ্জা এবং অপরাধ: অ্যাডাম গ্রান্ট তাঁর গবেষাণায় দেখেছেন, শিশুরা যখন কোনও একটা ক্ষতি করে (যেমন-কিছু একটা ভেঙ্গে ফেলে) বা খারাপ কাজ করে (মিথ্যা বলা) তখন তার মধ্যে যেকোন একটা অনুভূতি কাজ করে-লজ্জা বা দোষ। লজ্জা হচ্ছে এমন একটা অনুভূতি যেখানে শিশু মনে করে আমি একটা খারাপ মানুষ। আর দোষ এমন একটা অনুভূতি যেখানে শিশু মনে করে আমি একটা ভুল বা খারাপ কাজ করেছি।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অভিভাবকরা সাধারণত শিশুর কোন একটা ভুল বা খারাপ কাজের রাগ দেখায়, ভালবাসা কমিয়ে দেয় অথবা শিশুকে শাস্তি দেয় সেসব ক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে লজ্জার অনুভূতি আরও প্রকট হয়। এই উপায়ে শিশুর আচরণ ঠিক করা অনেক বড় ভুল ধারণা। তাই শিশুর কোন একটা খারাপ কাজ করার পর তাকে বলুন, আমি খুব হতাশ হয়েছি তোমার এই কাজে। তোমার কাছ থেকে এই ধরণের কাজ আমি আশা করি না। আমি জানি তুমি এমন না। এবার একটা ভুল করে ফেলেছো, সামনে আর হয়তো এমনটা হবে না। দয়া করে কখনোই বলবেন না, তুমি একটা গাধা বা বোকা। কতবার বলেছি এটা না করতে, তাও বার বার করো। তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না .. ইত্যাদি ইত্যাদি। ৫-৬ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর লজ্জার অনুভূতি তৈরি হয় তাই অন্যের সামনে তাকে ছোট করে কোন কথা বলবেন না।
বিশ্বের সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সিঙ্গাপুর ও জাপান। জাপানে শিক্ষার শুরুতে শিশুদের ৩বছর নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। জাপানিরা বিশ্বাস করে মেধা যাচাইয়ের উপযুক্ত সময় এটি নয়। প্রথম ৩ বছর শিশুদের খেলাধূলা ও আনন্দের মাধ্যমে শেখানো হয় কিভাবে ছোট ও বড়দের সাথে ব্যবহার করতে হয়, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, বিশ্বস্ততা, সততা ও মিথ্যা কথা না বলা, ধৈর্য্যশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, বিনয়ী ও ভদ্র হওয়া, কৃতজ্ঞতাবোধ প্রভৃতি।
শেষ করবো জাপানের একটি ভাস্কর্যের মর্মকথা দিয়ে। জাপানের রাজধানী টোকিওর উত্তরপূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ও বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নিক্কো পর্যটন কেন্দ্র। নিক্কো তোশোগু শ্রাইনের তিন বিজ্ঞ বানরের একটি ভাস্কর্য আছে। ৩টি বানরের একটি নিজের চোখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ জিনিস দেখব না, দ্বিতীয়টি মুখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা বলবো না’এবং তৃতীয় বানরটি কানের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা শুনবো না। পরিবার এবং স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই শুরু হোক নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন। শিক্ষার লক্ষ্য হোক সত্যিকারের মানুষ হওয়া।
লেখক: বেসরকারি সংস্থা ভাব-বাংলাদেশ শিক্ষা প্রোগ্রামের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




পরিবার স্কুল থেকেই শুরু হোক নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন -এম. এ. আলিম খান

আপডেট সময় : ০২:৩৭:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

এম. এ. আলিম খানঃ

“জাপানের রাজধানী টোকিওর উত্তরপূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ও বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নিক্কো পর্যটন কেন্দ্র। নিক্কো তোশোগু শ্রাইনের তিন বিজ্ঞ বানরের একটি ভাস্কর্য আছে। ৩টি বানরের একটি নিজের চোখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ জিনিস দেখব না, দ্বিতীয়টি মুখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা বলবো না এবং তৃতীয় বানরটি কানের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা শুনবো না। পরিবার এবং স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই শুরু হোক নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন। শিক্ষার লক্ষ্য হোক সত্যিকারের মানুষ হওয়া।”
নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিনদিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনা বা সামান্য স্বার্থের জন্য কত মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। নৈতিক বা অনৈতিক যেভাবেই হোক আমরা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া। দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার লাগাম না টানলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে। তবে আমরা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছি। নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কাজ শুরু করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয়ের আকস্মিক স্কুল পরিদর্শন আমাদের আশান্বিত করছে। ইতোমধ্যে স্কুলে প্রাত্যহিক সমাবেশে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দুইটি নৈতিকবাক্য পাঠ করানোর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সব স্কুলে চিঠি দেয়া হয়েছে। সরকারকেও এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে। আমরা প্রত্যশা করি, দুর্নীতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
“সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।” কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘আমার পণ’ কবিতার এই লাইনগুলো অন্তরে ধারণ করা লোকের সমাজে আজ বড় অভাব। আমাদের পাঠ্যবই খুবই সমৃদ্ধ ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য আদর্শগুণাবলী অর্জনের জন্য যথেষ্ট তার পরও কেন জানি কোথায় গলদ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. আতিউর রহমানের মতে, “মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ যেমন- শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার বাণিজ্যিক প্রবণতা ও কাঠামোগত ত্রুটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ত্বরান্বিত করছে।”
সমাজকাঠামোর অবিচ্ছেদ্য একটি উপাদান মূল্যবোধ যা সামাজিক আচার আচরণের সমষ্টি। ফ্রাঙ্কেল এর মতে, “মূল্যবোধ হলো আবেগ ও আদর্শগত ঐক্যের বোধ।” মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যবোধ। নৈতিকতার ও মূল্যবোধ অর্জনের প্রধান উৎস পরিবার। শিশুকাল থেকে মূল্যবোধের বিকাশ শুরু হয়। মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়তে ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও বাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকায় কয়েকজন ব্যক্তি মিলে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট ও বুয়েটের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. ইকবাল মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার এ. এম.এম. খায়রুল বাশার। আমরা এখন বিভিন্ন স্কুলে যে ‘সততা স্টোর’ বা অনেস্টি শপ দেখছি এটা প্রথম ২০১৬ সালে বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা উক্ত সততা স্টোর ৫বার পরিদর্শন করেন। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে দুদক মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ৫টি করে মোট ১০টি স্কুলে ‘সততা স্টোর’চালু করে। সততা স্টোরের সফলতা পর্যালোচনা দুদক দেশের বিভিন্ন উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’চালু করতে উৎসাহিত করছে। দুদকের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৫,১২৯টি ‘সততা সংঘ’এবং ৮২৪টি ‘সততা স্টোর’ রয়েছে।
বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো ‘পরিদর্শক বিহীন পরীক্ষা’। নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিবেন কিন্তু কোন পরিদর্শক থাকবে না। পরীক্ষার আগে শিক্ষকরা খাতা ও প্রশ্নপত্র রেখে দিবেন। পরীক্ষা শুরুর আগে ঘন্টা পড়লে শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে নির্ধারিত আসনে বসবেন। যথাসময়ে ঘন্টা পড়লে শিক্ষার্থীরা লেখা শুরু করবে। পরীক্ষা শুরুর ৩০মিনিট পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একজন শিক্ষক আসবেন এবং প্রশ্নপত্রে কোন ভুল থাকলে তা সংশোধন করে দিবেন। পরীক্ষা শেষের ১৫ মিনিট পূর্বে সতর্ক ঘন্টা দেয়া হয়। চূড়ান্ত ঘন্টা পড়লে শিক্ষার্থীরা লেখা বন্ধ করে নিজ আসনে বসে থাকবে। সংশ্লিষ্ট কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক উত্তরপত্র বুঝে নেয়ার পর শিক্ষার্থীরা আবার সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরীক্ষার হলের বাইরে চলে যাবেন। বাংলাদেশ এথিক্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট অ্যাডাম গ্রান্ট যিনি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা করেছেন কীভাবে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা বৃদ্ধি করা যায়। তিনি শিশুদের নৈতিকতা বৃদ্ধির জন্য অভিভাবকদের ৩টি পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রশংসা এবং পুরস্কার: শিশুর বয়স ২ বছরের পর থেকে ভাল মন্দ বুঝতে শেখে। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল এটা বুঝতে শেখে। আপনি যদি আপনার শিশুর মধ্যে অপরের জন্য সমবেদনা বা সহানুভূতি তৈরি করতে চান তাহলে তার কাজের প্রশংসা করুন। সে একটি ভাল কাজের জন্য প্রশংসা পেলে পরবর্তিতে আরও ভাল কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে।
ভাষা প্রয়োগে কৌশলী হওয়া: শিশুর নৈতিক আচরণ বৃদ্ধি করতে তার প্রশংসা করার সময় ভাষা প্রয়োগে আপনাকে কৌশলী হতে হবে। ধরুন আপনার শিশু তার খেলনা কারও সাথে শেয়ার করলো, নিজের চকলেট থেকে ছোট ভাই-বোনকে দিল। তখন তাকে আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘বাহ তুমি তোমার খেলনাটি শেয়ার করে খুব ভাল একটা কাজ করেছো। কিন্তু গবেষণা বলছে আপনি যদি বলেন, ‘বাহ, তুমিতো খুব শেয়ারিং’ তাহলে পরবর্তীতে শিশু আবারও কোন জিনিস শেয়ার করতে আগের চেয়ে উৎসাহ পাবে বেশি। এখানে আপনি যেটা করছেন তা হলো আপনি তার ভাল কাজের প্রশংসা না করে ভাল চরিত্রের প্রশংসা করলেন। ‘প্রতারণা করো না’ না বলে তাকে বলুন ‘প্রতারক হয়ো না’। ঠিক একইভাবে আপনি শিশুকে আপনার কোন কাজে সাহায্য করতে বলতে চান, তাহলে ‘তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? এটি না বলে বলুন, ‘তুমি কি সাহায্যকারী হতে পারবে একটু?’ এখানে যে বিষয়টি হচ্ছে তা হল শিশু যখন তার চরিত্রের সাথে ভাল গুণগুলো যোগ হতে দেখে তখন সে আরও বেশি উৎসাহিত হয় ভাল কাজটি আবার করতে।
লজ্জা এবং অপরাধ: অ্যাডাম গ্রান্ট তাঁর গবেষাণায় দেখেছেন, শিশুরা যখন কোনও একটা ক্ষতি করে (যেমন-কিছু একটা ভেঙ্গে ফেলে) বা খারাপ কাজ করে (মিথ্যা বলা) তখন তার মধ্যে যেকোন একটা অনুভূতি কাজ করে-লজ্জা বা দোষ। লজ্জা হচ্ছে এমন একটা অনুভূতি যেখানে শিশু মনে করে আমি একটা খারাপ মানুষ। আর দোষ এমন একটা অনুভূতি যেখানে শিশু মনে করে আমি একটা ভুল বা খারাপ কাজ করেছি।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অভিভাবকরা সাধারণত শিশুর কোন একটা ভুল বা খারাপ কাজের রাগ দেখায়, ভালবাসা কমিয়ে দেয় অথবা শিশুকে শাস্তি দেয় সেসব ক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে লজ্জার অনুভূতি আরও প্রকট হয়। এই উপায়ে শিশুর আচরণ ঠিক করা অনেক বড় ভুল ধারণা। তাই শিশুর কোন একটা খারাপ কাজ করার পর তাকে বলুন, আমি খুব হতাশ হয়েছি তোমার এই কাজে। তোমার কাছ থেকে এই ধরণের কাজ আমি আশা করি না। আমি জানি তুমি এমন না। এবার একটা ভুল করে ফেলেছো, সামনে আর হয়তো এমনটা হবে না। দয়া করে কখনোই বলবেন না, তুমি একটা গাধা বা বোকা। কতবার বলেছি এটা না করতে, তাও বার বার করো। তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না .. ইত্যাদি ইত্যাদি। ৫-৬ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর লজ্জার অনুভূতি তৈরি হয় তাই অন্যের সামনে তাকে ছোট করে কোন কথা বলবেন না।
বিশ্বের সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সিঙ্গাপুর ও জাপান। জাপানে শিক্ষার শুরুতে শিশুদের ৩বছর নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। জাপানিরা বিশ্বাস করে মেধা যাচাইয়ের উপযুক্ত সময় এটি নয়। প্রথম ৩ বছর শিশুদের খেলাধূলা ও আনন্দের মাধ্যমে শেখানো হয় কিভাবে ছোট ও বড়দের সাথে ব্যবহার করতে হয়, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, বিশ্বস্ততা, সততা ও মিথ্যা কথা না বলা, ধৈর্য্যশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, বিনয়ী ও ভদ্র হওয়া, কৃতজ্ঞতাবোধ প্রভৃতি।
শেষ করবো জাপানের একটি ভাস্কর্যের মর্মকথা দিয়ে। জাপানের রাজধানী টোকিওর উত্তরপূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ও বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নিক্কো পর্যটন কেন্দ্র। নিক্কো তোশোগু শ্রাইনের তিন বিজ্ঞ বানরের একটি ভাস্কর্য আছে। ৩টি বানরের একটি নিজের চোখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ জিনিস দেখব না, দ্বিতীয়টি মুখের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা বলবো না’এবং তৃতীয় বানরটি কানের উপর হাত রেখে বলছে, ‘মন্দ কথা শুনবো না। পরিবার এবং স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই শুরু হোক নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন। শিক্ষার লক্ষ্য হোক সত্যিকারের মানুষ হওয়া।
লেখক: বেসরকারি সংস্থা ভাব-বাংলাদেশ শিক্ষা প্রোগ্রামের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার