নিজস্ব প্রতিবেদক:
মিরপুর পাইকপাড়ার সরকারি কোয়ার্টার ও আবাসিক এলাকায় সবজির ব্যবসা করতেন মধ্যবয়সী শামসুল মিয়া। ভাড়ায় থাকতেন পীরেরবাগের একটি টিনশেড বাড়িতে। মানিকগঞ্জ ও সাভার থেকে নিজের ভ্যানেই টাটকা সবজি কিনে বিক্রি করতেন। ভালো বিক্রিও হতো। কিন্তু করোনায় কড়াকড়ি, হয়রানি আর সংক্রমণের ভীতিতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় তার। জীবিকার কোনো পথ না দেখে ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন শামসুল। সম্প্রতি সেই টিনশেড ঘর ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ফিরে গেছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার গ্রামের বাড়িতে।
শামসুলের চাচাত ভাই ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী সবুজ মিয়ার ভাষ্য, ‘আমরা একসাথেই পীরেরবাগ মাইকের গলিতে একটি টিনশেড ভবনের দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকতাম। খরচা পড়ত নয় হাজার টাকা। করোনাভাইরাসের কারণে শামসুল ভাইয়ের সবজি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তার মধ্যে করোনার ভীতি। বাধ্য হয়ে গত মাসে ঢাকা ছেড়ে গেছেন। তার সাথে আমিও স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এখন আরও তিনজনের সাথে ওই কক্ষ শেয়ার করে থাকি।’
শুধু শামসুল কিংবা সবুজ মিয়া নন, করোনাভাইরাসের কারণে এমন লাখো নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। তাদের অনেকে ঢাকা ছেড়ে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। আবার অনেকে স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে পাঠিয়ে রোজগারের জন্য বাধ্য হয়ে থেকে যাচ্ছেন রাজধানীতে। সেজন্য কম ভাড়ার টিনশেড বাড়িও ফাঁকা হচ্ছে। কিছু বাড়িতে এখন অনেক শ্রমজীবী বা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো একসঙ্গে থাকছেন।
রাজধানীর মিরপুর, ষাট ফিট, পাইকপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বহুতল ভবন থেকে টিনশেড—প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই ঝুলছে বাসা ভাড়া দেয়ার ‘টু-লেট’ বিজ্ঞাপন।
পাইকপাড়া এলাকার টিনশেড বাড়ির মালিক আবুল কালাম। বলেন, ‘আমগোও বিপদ, ভাড়াটিয়াগোও বিপদ। ১৫টা ঘর ভাড়া দিয়ে আমার সংসার চলে। এখন ফাঁকা পইড়া আছে চারডা। এমন দিন ছিল, ভাড়াটিয়া কখনও যাইত না। অহন ওই চারডা ঘরের ভাড়াটিয়া পাইতাছি না। করোনা যে কত দিনে পালাইব!’
‘একটা মিষ্টির কারখানায় চাকরি করতাম। করোনার কারণে মিষ্টি উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। আমার চাকরিটাও চলে যায় মে-তে। গত জুন মাসে বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তানকে বাড়িতে পাঠায় দিছি। এখন ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠছি একটা মেসে। চলতে তো হবে। তাই নিজের বাইকে পাঠাও চালাচ্ছি। পাশাপাশি চাকরি খোঁজার চেষ্টা করছি’— বলছিলেন মাইকের গলির একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আব্দুস সবুর মিয়া।
ঢাকা ছাড়ছে কেন মানুষ— প্রশ্ন রাখা হয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহারের কাছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা শ্রমজীবী, দিনে কাজ করলে দিনের খাবার জুটত, তাদের অবস্থা করুণ। না বাড়ি যেতে পারছে, না ঢাকায় থাকতে পারছে। আমাদের দাবি ছিল অন্তত তিন মাসের ভাড়া মওকুফ করা হোক। সেটা মানা হয়নি। আবার শ্রমজীবী মানুষের জন্য স্থায়ী কোনো সমাধানও দেয়া হয়নি।
‘এদিকে করোনার ছোবল বাড়ছেই। নতুন নতুন এলাকা লকডাউন হচ্ছে। যাদের পকেটে কাঁচা টাকা নেই, টিনশেড বাড়িতে থাকে— এমন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কিছু করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভাড়া বাড়িতে বসবাসকারী একজন মানুষ নিজ আয়ের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ খরচ করেন বাসা ভাড়ায় পেছনে। যে মানুষের পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা এদিক-ওদিক হলে পুরো মাসের জীবনধারণের কায়দায় পরিবর্তন আনতে হয়, তার কাছে আয়ের অন্তত ৩০ শতাংশ জমিয়ে রাখার ভাবনা এবং আয়বিহীন অবস্থায় তা বাড়ি ভাড়ায় খরচ করে ঢাকায় বসে থাকার চিন্তাও অসম্ভব। সুতরাং ভাড়া বাড়ি ছেড়ে সপরিবার গ্রামে চলে যাওয়া কিংবা পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে থাকা অনেকের জন্য সুবিধাজনক।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পক্ষ থেকে অনেক আগেই জানানো হয়েছিল যে, করোনার প্রাদুর্ভাবে অন্তত এক কোটি তিন লাখ মানুষ চাকরি খোয়ানোর ঝুঁকিতে আছেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন মানববন্ধন করে তিন মাসের বাসা ভাড়া মওকুফ এবং যাবতীয় বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছিল। হাউজিং ট্যাক্স এবং বিল মওকুফ করলে হয়তো বাড়ির মালিকেরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিন্তু সেটি করা হয়নি। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞসহ অনেকে আশা করেছিলেন, যাদের বাড়িভাড়া ৫০০০ টাকার নিচে, অর্থাৎ অত্যন্ত অল্প আয়ের মানুষের সুবিধায় বাড়ি ভাড়া পরিশোধের জন্য হয়তো সরকার কোনো প্রণোদনা ঘোষণা করলেও করতে পারে। সে রকমও কিছু ঘটেনি। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ঢাকা ছাড়ার হার বেশি।