অনলাইন ডেস্ক; তামাক কর ও মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে সরকার তামাক খাত থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জন করতে পারতো। দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ তামাককে করোনা সংক্রমণ সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য জোর তাগিদ দিয়ে আসছে। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে এসবের কোনো প্রতিফলন নেই। সিগারেটের ৪টি মূল্যস্তর বহাল রাখায় কমদামি সিগারেট বেছে নেয়ার সুযোগ অব্যাহত থাকবে এবং তরুণরা ধূমপান শুরু করতে উৎসাহিত হবে। ফলে সিগারেটের ব্যবহার না কমে বরং বৃদ্ধি পাবে। বাজেট প্রস্তাবে নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম মাত্র ২ টাকা বাড়িয়ে ৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি শলাকায় দাম বৃদ্ধি পাবে মাত্র ২০ পয়সা বা ৫.৪ শতাংশ। অথচ একইসময়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১১.৬ শতাংশ। সিগারেট বাজারের প্রায় ৭২ শতাংশই নিম্নস্তরের সিগারেটের দখলে। এই স্তরে সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়েছে ৫৭ শতাংশ, যা গতবছর ছিল ৫৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেট কার্যকর হলে এই স্তরের সিগারেটের প্রকৃতমূল্য হ্রাস পাবে এবং ব্যবহার বাড়বে। বিড়ির শলাকা প্রতি মাত্র ১৬ পয়সা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে বিড়ির ব্যবহার কমবেনা বরং দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, ১০ গ্রাম জর্দার দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা সন্তোষজনক। তবে ১০ গ্রাম গুলের দাম বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫ টাকা। এরফলে নারী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে এসব তামাকপণ্যের ব্যবহার খুব একটা কমবেনা। সার্বিকভাবে অতিরক্তি রাজস্ব আহরণ, অকাল মৃত্যুরোধ এবং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাসে প্রস্তাবিত তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ কোনো ভূমিকা রাখবেনা, যা অত্যন্ত হতাশাজনক।
প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যমস্তরে সিগারেটের দাম না বাড়িয়ে ৬৩ টাকা রাখা হয়েছে। উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম যথাক্রমে ৪ টাকা এবং ৫ টাকা বৃদ্ধি করে ৯৭ টাকা এবং ১২৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই তিনটি মূল্যস্তরে বর্তমান ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা হয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তুলনায় দাম বৃদ্ধি কম হওয়ায় সিগারেটের প্রকৃতমূল্য হ্রাস পাবে। তামাকবিরোধীদের দাবি অনুযায়ী সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি এবং সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কর আকারে আরোপ না করায় সরকার অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে এবং তামাক কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধি পাবে ফলে তারা মৃত্যুবিপণনে আরো উৎসাহিত হবে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এছাড়াও করোনাভাইরাস সংক্রমণের আর্থিক এবং স্বাস্থ্য ক্ষতি মোকাবেলায় ৩ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করার দাবি জানানো হয়েছিল যার প্রতিফলন বাজেট ঘোষণায় নেই।
জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। করোনা মহামারী চলাকালীন বিগত ২ মাস ধরে বিড়ি শ্রমিকদের ব্যবহার করে কারখানার মালিকপক্ষ যে অযৌক্তিক আন্দোলন চালিয়েছে তার ফল স্বরূপ বাজেট ঘোষণায় তাদেরকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির মূল্য মাত্র ৪ টাকা বৃদ্ধি করে ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রতি শলাকা বিড়ির মূল্য বৃদ্ধি পাবে মাত্র ১৬ পয়সা। এরফলে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিড়ির ব্যবহার আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, টানা পঞ্চম বছরের মত বিড়ির সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশে বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নি:সন্দেহে জনস্বাস্থ্যবিরোধী।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, সম্পূরক শুল্ক ধার্য্ করা হয়েছে ৫৫ শতাংশ। ধোয়াঁবিহীন তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে এই মূল্য বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবেনা। বাংলাদেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। বাস্তবতা হলো মোট তামাক রাজস্বের ১ শতাংশেরও কম আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে। সুতরাং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য থেকে সরকারের বাড়তি রাজস্ব আয়ের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে রপ্তানি শুল্ক অব্যাহতির সুযোগ প্রস্তাবিত বাজেটেও রাখা হয়েছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং খাদ্যশস্য চাষাবাদ ও পরিবেশবিরোধী পদক্ষেপ। এরফলে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাবে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এবং কোভিড-১৯ মহামারী পরবর্তী সময়ে দেশের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বাধার সৃষ্টি করবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখিয়ে দিয়েছে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ কতটা জরুরি। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তামাকপণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে প্রস্তাবিত বাজেটে কার্যকর কর ও মূল্য বৃদ্ধির পদক্ষেপ উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে সরকার অতিরিক্ত প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে, ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহারকারী ও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৪ কোটি ১০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নজিরবিহীন স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়বে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের লক্ষ্যও বাধাগ্রস্ত হবে।