ঢাকা ০৪:৫৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




পুলিশকে জানাই স্যালুট!

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৩৩:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ মে ২০২০ ২৮২ বার পড়া হয়েছে

অনলাইন ডেস্ক; 

ঘটনা ১: ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে মির্জাপুর উপজেলার পোষ্টকামুরী চড়পাড়া এলাকায় এক ব্যক্তি মাটিতে পড়ে ছিলেন। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, এমন আতঙ্কে দিনভর স্থানীয়দের কেউ তাঁর পাশে যাননি। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে পাঠায়।

ঘটনা ২: নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর বাড়ির পাশে গিটারিস্ট হিরো লিসানের লাশ পড়ে থাকার খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঠাণ্ডা, জ্বর, শ্বাসকষ্টে ৭ এপ্রিল ভোররাতে হিরোর মৃত্যু হয়। ভোরেই হিরোর বাড়ি দেওভোগ কৃষ্ণচূড়া এলাকা থেকে মরদেহ একটি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়ে চালক মরদেহ ফেলে রেখে চলে যায়। এসময় পরিবারের লোকও কাছে আসেনি। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মরদেহটিকে দাফন করেছে।

এখন পুলিশের উদারতার এমন হাজারো ঘটনা গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে। যা ভাবা যায়নি, যা দেখা যায়নি, যার কাছে যা আশা করা যায়নি, এমন অনেক কিছুই আমরা এই করোনাভাইরাস মহামারিকালে দেখছি। মারণ ভাইরাসের ছোবলে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখে লড়ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রাণও দিচ্ছেন। তাঁদের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে মানুষকে রক্ষা করতে মাটি কামড়ে লড়ছে পুলিশ। তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণ দিচ্ছেন।

সংক্রামক ব্যাধি হোক বা না হোক, রোগে আক্রান্ত মানুষকে সেবা দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা চিকিৎসক ও চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজ। সেটা কোনোভাবেই পুলিশের নয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, জঙ্গি–সন্ত্রাস মোকাবিলা বা দুর্ঘটনায় পুলিশ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সহায়তাও করেছে। সেটাও ছিল স্থান-কাল-পাত্রবিশেষে। এখন সেখানে করোনাভাইরাস এনে দিয়েছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা দুনিয়াজুড়ে। এখানে ‘ব্যবস্থাপত্র’ হিসেবে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক নতুন দাওয়াই যার নাম ‘লকডাউন’। যেন জীবন বাঁচাতে ওষুধ ও লকডাউন—দুটো দাওয়াই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই লকডাউন বাস্তবায়নের কারিগর হচ্ছেন পুলিশ।

ঘরে থাকলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হবে না। তাই মানুষকে ঘরে রাখতে পুলিশ কখনও চালাচ্ছেন লাঠি, কখনও অসহায়ের সহায় হচ্ছেন। করোনাভাইরাস রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসা, চিকিৎসাশেষে বাসায় পৌঁছে দেয়া, কখনও হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের নজরদারি করা, এমনকি অভাবী মানুষের জন্য বরাদ্দ সরকারি ত্রাণ যেন চুরি না হয়, সেজন্যও তারা ভূমিকা পালন করছেন। কোথাও করোনাভাইরাসের রোগীর হদিস পেলেই গড়ে তুলছেন ব্যারিকেড। আগলে রাখছেন সবাইকে। আচরণে, দায়িত্ব পালনে, কর্তব্যবোধে পুলিশ আজ যেন ত্রাতার ভূমিকায়। পুলিশের এমন অনন্য ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ অতীতে কখনও দেখেছ কি না, সন্দেহ!

ভাইরাস আতঙ্ক অনেকের মধ্যে জাগিয়েছে মৃত্যুভয়। মারণ ভাইরাসের বিস্তার যত ঘটছে, ততই আতঙ্ক বাড়ছে। আতঙ্কে লোপ পাচ্ছে হিতাহিত জ্ঞান। গুলিয়ে যাচ্ছে শত্রু-মিত্র বোধ। হয়তো এমনটাই হয়। কারণ এমন বিপদের মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের নেই। নেই এমন দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার অভিজ্ঞতা। হয়তো সেই কারণেই এই অস্থিরতা। এমন এক বিরল পরিস্থিতিতে পুলিশ পরিণত হয়েছে ভরসা আর আস্থার প্রতীকে।

স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন লড়ছেন হাসপাতালের অন্দরে, তখন বাইরেটা সামলাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ মানেই ইউনিফরম, হাতে লাঠি, কাঁধে বন্দুক অথবা কোমরে পিস্তল। পুলিশ মানেই চাঁদাবাজির অভিযোগ। পুলিশ মানেই অত্যাচার। পুলিশ মানেই মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর মাস্টার মাইন্ড। এতদিন বেশিরভাগ মানুষের কাছে অধিকাংশ পুলিশের ভাবমূর্তি এমনটাই ছিল। তাই পুলিশের কথা শুনলেই টানটান হতো শিরদাঁড়া। শক্ত হয়ে যেত চোয়াল। কিন্তু, করোনাভাইরাসের আবহে সেই ভাবনা বদলের সময় হয়েছে। লাঠির বদলে পুলিশের হাতে মাইক্রোফোন। হুমকি নয়, শোনা যাচ্ছে ঘরে থাকার আহ্বান। প্রাণঘাতী রিভলবারের খাপে এখন জীবনদায়ী স্যানিটাইজার। পথচলতি মানুষের হাত জীবাণুমুক্ত করে পুলিশ পরিয়ে দিচ্ছে মাস্ক। করোনার ঢাল। কোথাও তারা ছিন্নমূলদের ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে, কোথাও বেওয়ারিশ পশুকে দিচ্ছে খাবার। এতদিন পুলিশ ছিল আইনের রক্ষকের ভূমিকায়। আইনকে মানতে বাধ্য করাই ছিল প্রধান কাজ। ফলে আইন ভঙ্গকারীর সঙ্গে পুলিশের সংঘাত ছিল অনিবার্য। কিন্তু, আজ পুলিশ শাসক থেকে হয়ে গিয়েছে সহায়ক। বদলে গিয়েছে চিত্রনাট্য।

মানুষ যখন করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে আটকা পড়েছে ঘরে, তখন গ্রাম থেকে গঞ্জ, শহরের রাজপথ থেকে অলিগলি, শুধুই পুলিশের পদচারণা। করোনাভাইরাসের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লড়ছে বুক চিতিয়ে। বীর যোদ্ধার মতো। ‘করোনা জোন’-এর নাম শুনলে যখন ভয়ে মানুষের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, তখন পুলিশ ছুটছে সেখানেই। গড়ে তুলছে ব্যারিকেড। মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিচ্ছে কাঁধে। পুলিশ হয়ে উঠছে আপনজন। কোনো এলাকায় অচেনা কেউ ঢুকলে চ্যালেঞ্জ করছে। সেই সূত্রেই কোথাও কোথাও মিলছে করোনা আক্রান্তের হদিস। অসুস্থকে হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবারকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোয়ারেন্টাইনে। বাঁচছে পরিবার। বেঁচে যাচ্ছে গ্রাম।

করোনা মহামারির কালে তুলনামূলকভাবে আইনশৃঙ্খলার ঝক্কি কম। নেই ট্রাফিকের চাপ। তাই সমস্ত ফোর্স আজ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পুলিশ হয়ে উঠেছিল সমাজ জীবনের ব্যঙ্গ চরিত্রের মডেল। পদে পদে অভিযোগের আঙুল। সিনেমার পুলিশ মানেই যেন কমেডিয়ান ক্যারেক্টার। হাসির খোরাক। পেট এতটাই মোটা যে বেল্টও তাকে বেঁধে রাখতে অক্ষম। তাই দরকার হতো ৫৬ ইঞ্চির। ছাতি নয়, কোমর। ঘটনার অনেক পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছনোয় তুলনা হতো রামধনুর সঙ্গে। ঝড় বৃষ্টির পর রামধুন যেমন আকাশে শোভা পায়, তেমনটাই নাকি পুলিশ। সেই পুলিশ, হ্যাঁ সেই পুলিশই এখন এক ফোনে পৌঁছে যাচ্ছে এলাকায়। দূর করছে সমস্যা, মেটাচ্ছে চাহিদাও।

ছোটবেলায় শোনা, বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়। ধর্মগ্রন্থও সেকথাই বলছে। উৎসবে, বিপদে, রাজদ্বারে, দুর্ভিক্ষে, শ্মশানে যে পাশে থাকে সেই হল প্রকৃত বন্ধু। সেই বন্ধুর কর্তব্য পালন করতে গিয়েই আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ। তবু তারা কর্তব্য পালনে অবিচল। মারণ ভাইরাসের ছোবলে কেউ মারা গেলে যখন পরম আত্মীয়ও মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, তখন পুলিশই হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভরসা।

এ বছর জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে পুলিশের স্লোগান ছিল ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার’। এই স্লোগানটি সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপায়িত হতে চলেছে। পুলিশ এখন জনতার পুলিশেই পরিণত হয়েছে। অথচ এ জন্য অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হতো পুলিশ জনগণের বন্ধু। তবে সেটা এতদিন কার্যকর করা যায়নি। কিন্তু করোনা মহামারির বিপদের দিনে মানুষ বুঝতে পেরেছে পুলিশের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নেই। করোনায় নিশ্চয়ই এটা আমাদের সবেচেয়ে বড় পাওয়া।

করোনা-ঝড় নিশ্চয়ই একদিন থেমে যাবে। পৃথিবীটা আবার শান্ত হবে। তখন পুলিশ হয়তো আবার পুলিশই হয়ে যাবে। হয়তো আবার উঠবে অভিযোগের আঙুল। সম্পর্কের সংঘাতে পাশাপাশির অবস্থান বদলে আমরা হয়তো আবার হব মুখোমুখি। তবে করোনাকালে পুলিশের দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা আমাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করতে হবে। আমরা গর্ব ভরে বলতে পারব করোনা বিরোধী লড়াইয়ে স্বাস্থ্যকর্মী আর পুলিশ আমাদের জন্য জীবন বাজি রেখে পাশে থেকেছে। তাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

পুনশ্চ: পুলিশ প্রতিনিয়ত নিজেদের এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করছে। বর্তমানে দায়িত্ব, কর্তব্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার বাস্তব দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন পুলিশ কনস্টেবল জসিম উদ্দিন। এই করেনাকালে আমরা দেখি করোনাভাইরাস তো দূরের কথা সাধারণ রোগে কেউ মারা গেলেও মৃতদেহের কাছে কেউ যান না। পাড়া প্রতিবেশী তো অনেক দূরের, আপনজনরাও মুখ ফিরিয়ে থাকেন। দাফনের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কনস্টেবল জসিম উদ্দিনের সহকর্মীরা তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে তাঁকে ছেড়ে যাননি। তাকে ঠিকমত দাফন করেছেন। দাফনের আগে জানাজা পড়েছেন। জানিয়েছেন সহকর্মীর প্রতি বীরোচিত সম্মান।

পুলিশের প্রতি জানাই স্যালুট!

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




পুলিশকে জানাই স্যালুট!

আপডেট সময় : ১০:৩৩:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ মে ২০২০

অনলাইন ডেস্ক; 

ঘটনা ১: ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে মির্জাপুর উপজেলার পোষ্টকামুরী চড়পাড়া এলাকায় এক ব্যক্তি মাটিতে পড়ে ছিলেন। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, এমন আতঙ্কে দিনভর স্থানীয়দের কেউ তাঁর পাশে যাননি। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে পাঠায়।

ঘটনা ২: নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর বাড়ির পাশে গিটারিস্ট হিরো লিসানের লাশ পড়ে থাকার খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঠাণ্ডা, জ্বর, শ্বাসকষ্টে ৭ এপ্রিল ভোররাতে হিরোর মৃত্যু হয়। ভোরেই হিরোর বাড়ি দেওভোগ কৃষ্ণচূড়া এলাকা থেকে মরদেহ একটি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়ে চালক মরদেহ ফেলে রেখে চলে যায়। এসময় পরিবারের লোকও কাছে আসেনি। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মরদেহটিকে দাফন করেছে।

এখন পুলিশের উদারতার এমন হাজারো ঘটনা গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে। যা ভাবা যায়নি, যা দেখা যায়নি, যার কাছে যা আশা করা যায়নি, এমন অনেক কিছুই আমরা এই করোনাভাইরাস মহামারিকালে দেখছি। মারণ ভাইরাসের ছোবলে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখে লড়ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রাণও দিচ্ছেন। তাঁদের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে মানুষকে রক্ষা করতে মাটি কামড়ে লড়ছে পুলিশ। তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণ দিচ্ছেন।

সংক্রামক ব্যাধি হোক বা না হোক, রোগে আক্রান্ত মানুষকে সেবা দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা চিকিৎসক ও চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজ। সেটা কোনোভাবেই পুলিশের নয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, জঙ্গি–সন্ত্রাস মোকাবিলা বা দুর্ঘটনায় পুলিশ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সহায়তাও করেছে। সেটাও ছিল স্থান-কাল-পাত্রবিশেষে। এখন সেখানে করোনাভাইরাস এনে দিয়েছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা দুনিয়াজুড়ে। এখানে ‘ব্যবস্থাপত্র’ হিসেবে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক নতুন দাওয়াই যার নাম ‘লকডাউন’। যেন জীবন বাঁচাতে ওষুধ ও লকডাউন—দুটো দাওয়াই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই লকডাউন বাস্তবায়নের কারিগর হচ্ছেন পুলিশ।

ঘরে থাকলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হবে না। তাই মানুষকে ঘরে রাখতে পুলিশ কখনও চালাচ্ছেন লাঠি, কখনও অসহায়ের সহায় হচ্ছেন। করোনাভাইরাস রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসা, চিকিৎসাশেষে বাসায় পৌঁছে দেয়া, কখনও হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের নজরদারি করা, এমনকি অভাবী মানুষের জন্য বরাদ্দ সরকারি ত্রাণ যেন চুরি না হয়, সেজন্যও তারা ভূমিকা পালন করছেন। কোথাও করোনাভাইরাসের রোগীর হদিস পেলেই গড়ে তুলছেন ব্যারিকেড। আগলে রাখছেন সবাইকে। আচরণে, দায়িত্ব পালনে, কর্তব্যবোধে পুলিশ আজ যেন ত্রাতার ভূমিকায়। পুলিশের এমন অনন্য ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ অতীতে কখনও দেখেছ কি না, সন্দেহ!

ভাইরাস আতঙ্ক অনেকের মধ্যে জাগিয়েছে মৃত্যুভয়। মারণ ভাইরাসের বিস্তার যত ঘটছে, ততই আতঙ্ক বাড়ছে। আতঙ্কে লোপ পাচ্ছে হিতাহিত জ্ঞান। গুলিয়ে যাচ্ছে শত্রু-মিত্র বোধ। হয়তো এমনটাই হয়। কারণ এমন বিপদের মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের নেই। নেই এমন দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার অভিজ্ঞতা। হয়তো সেই কারণেই এই অস্থিরতা। এমন এক বিরল পরিস্থিতিতে পুলিশ পরিণত হয়েছে ভরসা আর আস্থার প্রতীকে।

স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন লড়ছেন হাসপাতালের অন্দরে, তখন বাইরেটা সামলাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ মানেই ইউনিফরম, হাতে লাঠি, কাঁধে বন্দুক অথবা কোমরে পিস্তল। পুলিশ মানেই চাঁদাবাজির অভিযোগ। পুলিশ মানেই অত্যাচার। পুলিশ মানেই মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর মাস্টার মাইন্ড। এতদিন বেশিরভাগ মানুষের কাছে অধিকাংশ পুলিশের ভাবমূর্তি এমনটাই ছিল। তাই পুলিশের কথা শুনলেই টানটান হতো শিরদাঁড়া। শক্ত হয়ে যেত চোয়াল। কিন্তু, করোনাভাইরাসের আবহে সেই ভাবনা বদলের সময় হয়েছে। লাঠির বদলে পুলিশের হাতে মাইক্রোফোন। হুমকি নয়, শোনা যাচ্ছে ঘরে থাকার আহ্বান। প্রাণঘাতী রিভলবারের খাপে এখন জীবনদায়ী স্যানিটাইজার। পথচলতি মানুষের হাত জীবাণুমুক্ত করে পুলিশ পরিয়ে দিচ্ছে মাস্ক। করোনার ঢাল। কোথাও তারা ছিন্নমূলদের ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে, কোথাও বেওয়ারিশ পশুকে দিচ্ছে খাবার। এতদিন পুলিশ ছিল আইনের রক্ষকের ভূমিকায়। আইনকে মানতে বাধ্য করাই ছিল প্রধান কাজ। ফলে আইন ভঙ্গকারীর সঙ্গে পুলিশের সংঘাত ছিল অনিবার্য। কিন্তু, আজ পুলিশ শাসক থেকে হয়ে গিয়েছে সহায়ক। বদলে গিয়েছে চিত্রনাট্য।

মানুষ যখন করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে আটকা পড়েছে ঘরে, তখন গ্রাম থেকে গঞ্জ, শহরের রাজপথ থেকে অলিগলি, শুধুই পুলিশের পদচারণা। করোনাভাইরাসের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লড়ছে বুক চিতিয়ে। বীর যোদ্ধার মতো। ‘করোনা জোন’-এর নাম শুনলে যখন ভয়ে মানুষের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, তখন পুলিশ ছুটছে সেখানেই। গড়ে তুলছে ব্যারিকেড। মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিচ্ছে কাঁধে। পুলিশ হয়ে উঠছে আপনজন। কোনো এলাকায় অচেনা কেউ ঢুকলে চ্যালেঞ্জ করছে। সেই সূত্রেই কোথাও কোথাও মিলছে করোনা আক্রান্তের হদিস। অসুস্থকে হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবারকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোয়ারেন্টাইনে। বাঁচছে পরিবার। বেঁচে যাচ্ছে গ্রাম।

করোনা মহামারির কালে তুলনামূলকভাবে আইনশৃঙ্খলার ঝক্কি কম। নেই ট্রাফিকের চাপ। তাই সমস্ত ফোর্স আজ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পুলিশ হয়ে উঠেছিল সমাজ জীবনের ব্যঙ্গ চরিত্রের মডেল। পদে পদে অভিযোগের আঙুল। সিনেমার পুলিশ মানেই যেন কমেডিয়ান ক্যারেক্টার। হাসির খোরাক। পেট এতটাই মোটা যে বেল্টও তাকে বেঁধে রাখতে অক্ষম। তাই দরকার হতো ৫৬ ইঞ্চির। ছাতি নয়, কোমর। ঘটনার অনেক পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছনোয় তুলনা হতো রামধনুর সঙ্গে। ঝড় বৃষ্টির পর রামধুন যেমন আকাশে শোভা পায়, তেমনটাই নাকি পুলিশ। সেই পুলিশ, হ্যাঁ সেই পুলিশই এখন এক ফোনে পৌঁছে যাচ্ছে এলাকায়। দূর করছে সমস্যা, মেটাচ্ছে চাহিদাও।

ছোটবেলায় শোনা, বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়। ধর্মগ্রন্থও সেকথাই বলছে। উৎসবে, বিপদে, রাজদ্বারে, দুর্ভিক্ষে, শ্মশানে যে পাশে থাকে সেই হল প্রকৃত বন্ধু। সেই বন্ধুর কর্তব্য পালন করতে গিয়েই আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ। তবু তারা কর্তব্য পালনে অবিচল। মারণ ভাইরাসের ছোবলে কেউ মারা গেলে যখন পরম আত্মীয়ও মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, তখন পুলিশই হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভরসা।

এ বছর জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে পুলিশের স্লোগান ছিল ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার’। এই স্লোগানটি সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপায়িত হতে চলেছে। পুলিশ এখন জনতার পুলিশেই পরিণত হয়েছে। অথচ এ জন্য অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হতো পুলিশ জনগণের বন্ধু। তবে সেটা এতদিন কার্যকর করা যায়নি। কিন্তু করোনা মহামারির বিপদের দিনে মানুষ বুঝতে পেরেছে পুলিশের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নেই। করোনায় নিশ্চয়ই এটা আমাদের সবেচেয়ে বড় পাওয়া।

করোনা-ঝড় নিশ্চয়ই একদিন থেমে যাবে। পৃথিবীটা আবার শান্ত হবে। তখন পুলিশ হয়তো আবার পুলিশই হয়ে যাবে। হয়তো আবার উঠবে অভিযোগের আঙুল। সম্পর্কের সংঘাতে পাশাপাশির অবস্থান বদলে আমরা হয়তো আবার হব মুখোমুখি। তবে করোনাকালে পুলিশের দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা আমাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করতে হবে। আমরা গর্ব ভরে বলতে পারব করোনা বিরোধী লড়াইয়ে স্বাস্থ্যকর্মী আর পুলিশ আমাদের জন্য জীবন বাজি রেখে পাশে থেকেছে। তাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

পুনশ্চ: পুলিশ প্রতিনিয়ত নিজেদের এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করছে। বর্তমানে দায়িত্ব, কর্তব্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার বাস্তব দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন পুলিশ কনস্টেবল জসিম উদ্দিন। এই করেনাকালে আমরা দেখি করোনাভাইরাস তো দূরের কথা সাধারণ রোগে কেউ মারা গেলেও মৃতদেহের কাছে কেউ যান না। পাড়া প্রতিবেশী তো অনেক দূরের, আপনজনরাও মুখ ফিরিয়ে থাকেন। দাফনের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কনস্টেবল জসিম উদ্দিনের সহকর্মীরা তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে তাঁকে ছেড়ে যাননি। তাকে ঠিকমত দাফন করেছেন। দাফনের আগে জানাজা পড়েছেন। জানিয়েছেন সহকর্মীর প্রতি বীরোচিত সম্মান।

পুলিশের প্রতি জানাই স্যালুট!