ঢাকা ০৪:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo বিএনপি নেতা মাহিদুর রহমান নেতৃত্বের বিস্ময় Logo স্বৈরাচারের দোসর প্রধান বিচারপতির ধর্ম ছেলে পরিচয়ে মোজাম্মেলের অধর্ম! Logo রাজধানীতে মার্কেট দখল করতে গিয়ে বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আটক Logo স্কুলের ভেতরে নিয়মিত চলে তাশ ও জুয়া! Logo চাঁদা চাওয়ায় দাকোপে ৫ আওয়ামীলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা Logo ভোলা জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আল আমিন সম্পাদক শামসউদ্দিন Logo বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এর উদ্যোগে দুমকিতে ক্যারিয়ার সামিট অনুষ্ঠিত Logo সওজ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে প্রচারিত প্রকাশিত মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ Logo বিপ্লবী গান, আবৃত্তি এবং কাওয়ালী গানে মেতেছে আশা বিশ্ববিদ্যালয় Logo ছত্রিশ টাকার নকলনবীশ প্রভাবশালী কোটিপতি!




বেসিক ব্যাংক ফতুর, ভালো আছে লুটেরাচক্র

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৩:৫১:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ২১৭ বার পড়া হয়েছে

২০০৯ থেকে গত কয়েক বছরে সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের ন্যায় রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকও হরিলুট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সরকারি এই ব্যাংকটি থেকে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি দুর্নীতিবাজ মাফিয়াচক্র। ২০১৪ সালে অনিয়ম ও লুটপাটের বিষয়টি প্রথমে প্রকাশ পায়। এর পর সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসে। পরিবর্তন আনা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায়। ২০০৯-১৩ সাল পর্যন্ত লাগামহীন লুটপাট, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দেড়শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলাও করে দুদক। ঘাটতি মেটাতে মূলধন সরবরাহ করে সরকার। তবে দুর্নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং এখনো অব্যাহত রয়েছে হরিলুট কা-। ফলে বারবার মূলধন সরবরাহ করে সরকার ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংকটির আমানতকারীরাও তাদের আমানত তুলে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এমন পরিস্থিতিতে লুট হওয়া অর্থ ফেরত আনতে না পারলে ব্যাংকটি রক্ষা করা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে বলে মত বিশ্লেষকদের। কিন্তু ঋণের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে দেয়া হয়েছে, যার কোনো অস্তিত্বই নেই। সঙ্গত কারণে, সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদসহ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও।
সূত্রমতে, বর্তমান সরকারের সময়ে লুটপাট হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি মেটাতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা মূলধন দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সহায়তা দিচ্ছে। এতে কোনো সুফল মিলছে না। ২০০৯-১৩ সালের মধ্যে দুর্নীতিতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটিতে ফের ঘটেছে অনিয়ম, লুটপাট ও ঋণ কেলেঙ্কারি। ফলে জনতা, সোনালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মতো বেসিক ব্যাংকটিও এখন ফতুর। অথচ সরকারি এই ব্যাংকটি লুটের মূলহোতা- ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ সাবেক পর্ষদ এবং ব্যবসায়ী নামের ব্যাংকলুটের মাফিয়াচক্র বেশ ভালোই আছেন। এর মধ্যে কেউ হয়েছেন পুরস্কৃত। কেউ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অর্থ-পাচারের পর নিজেরাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। তবে বেসিক ব্যাংকের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন কারাগারে আছেন। এ ক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাদের সখ্যতা তৈরির কথা বলে খোদ উচ্চ আদালত ‘লজ্জায় মুখ ঢাকার’ কথা বলেছেন। এমনকি এর পরও খুব একটা বদলায়নি দুদকের কার্যক্রম। ফলে বেসিক ব্যাংক লুটেরাদের আদৌ শাস্তি হওয়া ও লুট হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা থেকেই যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি লুটপাটের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গডফাদারদের কৌশলে আড়ালে রেখে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পর আদালতের নির্দেশে ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তা শেষ হয়নি। এ নিয়ে দুদক কর্মকর্তাদের ডেকে ভর্ৎসনা করেছেন আদালত। সেই সাথে সময়ও বেঁধে দেয়া হয়েছিল তদন্ত শেষ করতে। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময় চলতি বছরের জানুয়ারিতে পার হয়ে গেছে। তদন্ত শেষ হয়নি। কারণ, লুটেরাচক্র বড় শক্তি ও ক্ষমতাধর হওয়ায় তাদের কাছে দুদকও অসহায়। তাদেরকে জিজ্ঞাবাদের অনুমতি চেয়ে সময় পায় না দুদক। এ ক্ষেত্রে দুদক ‘ঠুটো জগন্নাথ’ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। আর ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসানে। অন্য সূত্র বলছে, ২০১৪ সালে প্রথমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট ধরা পড়ার পর ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও চলতি ২০১৮ সালেও ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকটিতে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থাৎ কোনোভাবেই অনিয়ম, দুর্নীতির লাগামটানা যাচ্ছে না সরকারি এই ব্যাংকটির। বরং নির্বাচনের বছরে এসে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্ম আরও বেপরোয়া গতি পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, দুর্নীতিতে ডুবন্ত বেসিক ব্যাংককে টেনে তোলার দায়িত্ব পাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান ব্যর্থ হয়েছেন। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করেছেন। এমডির হঠাৎ পদত্যাগের খবরে ফের নয়া সংকটে পড়েছে বেসিক ব্যাংক। এ অবস্থায় আমানতকারীরা আমানত তুলে নিতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন আশঙ্কার কাথা জানিয়েছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা। তবে অর্থমন্ত্রীর দাবি, এমডির পদত্যাগে কোনো সংকট দেখা দেবে না বেসিক ব্যাংকে।
এমডির পদত্যাগ
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান গত ১৪ আগস্ট পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তাকে এমডি পদে নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগ পেয়ে তিনি ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর ৩ বছরের জন্য বেসিক ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তার মেয়াদ ছিল। কিন্তু দুর্নীতিতে ডুবতে থাকা ব্যাংকটির চাপ নিতে না পেরে ১০ মাসের মধ্যে পদত্যাগ করলেন আউয়াল খান। ব্যাংকটিতে ইতিপূর্বে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটের পর ঋণের সুদহার কমানোর কারণে ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি করতে কর্মকর্তাদের কোনোরকমের সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না আউয়াল খান। তাই বাধ্য হয়ে মূলত পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শীর্ষকর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে বিভিন্ন সময়ে এমডির দেওয়া নির্দেশনাও পালন করেননি অনেক কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তারা অনেকে লুটেরা চক্রের সঙ্গে জড়িত। আর সেই কারণেই তাদের সঙ্গে এমডি আউয়াল খান পেরে উঠছিলেন না। তবে এমডির পদত্যাগে ‘বিচলিত নন’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, ‘এমডির পদত্যাগের কারণে বেসিক ব্যাংক নতুন করে কোনো সংকটে পড়বে না। পদত্যাগের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।’ ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
যেভাবে বেসিক ব্যাংক লুট
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রধান কার্যালয়ের সহযোগিতায় বেসিক ব্যাংকের গুলশান কার্যালয় থেকে ঋণের নামে এক দাগে ২৪৭ কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন আলোচিত মামা-ভাগ্নে। সিআইবি রিপোর্ট, বন্ধকী জমির মূল্যায়ন এবং এ বিষয়ে আইনজ্ঞের মতামত না নিয়েই মনিকা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৬৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা। ঋণ প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা রাজধানীর ঝিগাতলার মুন্সীবাড়ির ২৯/৯ নম্বর বাড়ি। এ ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায় একটি নির্মাণাধীন ভবন। এলাকাবাসীর মতে, নবনির্মিত এ ভবনের জমির মালিক অন্য একজন। সেখানে মনিকা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না কখনোই। জানা গেছে, ভবনটির মালিক মনিকা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মনির হোসেনের বড় ভাই সাবির হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, মনিকার মালিকের আপন ভাই সাবির হোসেনের প্রতিষ্ঠান এআরএসএস এবং ভাগ্নে হারিস মুহাম্মদ বিন মাকসুদের প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ গুলশান শাখার ১৭৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। এ ২টি প্রতিষ্ঠানও বেনামি ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেনি। খেলাপি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও সাবির হোসেনই মনির হোসেনের ঋণ হিসাবের শনাক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের এক পরিদর্শনে দেখা গেছে, মামা-ভাগ্নে এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে আরেক কোম্পানিতে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছেন। ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের ২০১২ সালের ২৭ মার্চের প্রস্তাবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২৮ মার্চ ৬০ কোটি টাকার এসওডি ঋণ অনুমোদন করে। একইভাবে এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারির প্রস্তাবে ১৮ জানুয়ারি পর্ষদ ৫০ কোটি টাকার এসওডি, ১০ কোটি টাকার এলসি বা ঋণপত্র ও পাঁচ কোটি টাকার এলটিআর অনুমোদন করে। পরবর্তীকালে গ্রাহকের ১৯ এপ্রিলের আবেদনে শাখার একই দিনের প্রস্তাবে পরিচালনা পর্ষদ ওই দিনই এসওডি ৯৫ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা জানান, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ধানমন্ডির ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির একটি নামফলক থাকলেও তা মূলত আর্কেড রিয়েল এস্টেটের অফিস। এ ২টি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী একই ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটির নামে নেওয়া ঋণের অধিকাংশ অর্থই আর্কেড রিয়েল এস্টেটের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ অর্থ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে আরও দেখা যায়, গুলশান শাখায় এসএফজি শিপিং লাইন, এস সুহি শিপিং লাইন, শিফান শিপিং লাইন ও এস রিসোর্স শিপিং লাইনের নামে ২৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করা হয়নি এক টাকাও। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন জুয়েল নামে এক ব্যক্তি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এ ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে বলে। কিন্তু সর্বশেষ পরিদর্শনে দেখা যায়, জুয়েলের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ আদায় দূরের কথা, তার আরও একটি বেনামি প্রতিষ্ঠান সুরমা স্টিলকে নতুন করে ৬৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এভাবে ৩৩৮ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।
জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক ম্যানেজার শিপার আহমেদের সময় বেশিরভাগ অনিয়ম হয়েছে এবং কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। ঋণ বণ্টনের অনিয়ম-দুনীতির তথ্য ফাঁস হলে শাস্তির বদলে তাকে লাভজনক পদে পদোন্নতি দিয়ে বদলি করা হয়। এমনকি তাকে ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চতুরতার আশ্রয় নেয়। শিপার আহমেদ যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া ঋণ দিয়েছেন সেসব ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকেই। কারণ অন্য কোনো কর্মকর্তাকে ওই ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দিলে শিপার আহমেদের দুর্নীতির তথ্য আরও আগেই ফাঁস হয়ে যেত।
ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা কী?
সরকারের ক্ষমতার সুবিধাভোগী ও জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছর বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসময় ব্যাংকটির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৪ সালে পদত্যাগে বাধ্য হন বাচ্চু। ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পর্ষদও ঢেলে সাজানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এর পরও ২০১৬ পর্যন্ত সব ধরনের সূচকে অবনতি হয়েছে ব্যাংকটির।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ও হরিলুট হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বিশাল অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। তাছাড়া ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দানের অন্তরালে তা লুটপাট হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নামের লুটেরাদের যোগসাজশে। ফলে সরকারের তথা জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, বেসিক ব্যাংকের ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন শেষ হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। ১৯তম এ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও ৬৮টি শাখার কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয় ও ৫টি বড় শাখার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। ২০১৫ সালেও এরকম একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নানা সমস্যায় থাকার পরও এককালীন পরিশোধের (ডাউন পেমেন্ট) শর্ত পরিপালন না করেই বড় অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বৃদ্ধি, জামানত গ্রহণ না করে ঋণ প্রদান, যাচাই ছাড়া এলসি খোলা এবং কৃষি ঋণের সুদ হিসাবে অনিয়ম করেছে বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা। পর্ষদ পরিবর্তন হলেও নতুন করে ব্যাংকটির মূলধন পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে সরকার ৭৯০ কোটি ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করেছে। দু’বছরে সরকার ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন দেয়।
গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১৫ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। যা ১০ বছর আগে ছিল ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। তবে এ আমানতের ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা এসেছে মাত্র ১ হাজার ৪০১টি আমানত হিসাব থেকে। এসব হিসাবে ১ কোটি বা এর বেশি টাকা মেয়াদি আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে। এসব আমানতকারীর কয়েকজন আমানত তুলে নিলেই ব্যাংকটি বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
৪,৩১৯ কোটি টাকা লুট : ব্যাংকটি আয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই অনাদায়ী সুদও আয় খাতে দেখাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলশান শাখায় ৭টি প্রতিষ্ঠানের ১০টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা আয় দেখানো হয়েছে। যদিও এসব অর্থ আদায় হয়নি। এ পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক অনাদায়ী সুদ আয় খাতে নিতে নিষেধ করেছে। মোট হিসাবে ব্যাংকটির সুদ আয় ঋণাত্মক ৩১৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সামগ্রিকভাবে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪,৩১৯ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এই টাকা লুট করা হয়েছে।
বেড়েছে খেলাপি ঋণ : ১ বছরে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। ২০১৬’র ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। যা ২০১৫’র ডিসেম্বরে ছিল ৬ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ নগদ আদায়ও কম হয়েছে ব্যাংকটির। ২০১৫ সালে ব্যাংকটি ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে আদায় করেছে মাত্র ১৪০ কোটি টাকা। আর গত বছরে মাত্র ১২ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে ব্যাংকটি। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হিসাব বলছে, বেসিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।
থেমে নেই দুর্নীতি-লুটপাট : সীমাহীন অনিয়ম করে কয়েক বছর ধরে সমালোচনায় থাকা বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতিমূলক কর্মকা- থেমে নেই। ২০১৬ সালেও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা না করে অনেক কাজ করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬’র শেষের দিকে বেসিক ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা আমানত নিয়েছে। ব্যাংকের নিট সুদ আয় ঋণাত্মক হওয়া সত্ত্বেও বছরের শেষ দিকে এমনকি শেষ কার্যদিবসেও বিরূপ শর্তে অন্য ব্যাংক থেকে আমানত নিয়েছে বেসিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, ব্যাংকের স্বার্থরক্ষা না করে কৃত্রিমভাবে স্থিতিপত্রের আকার বাড়ানোর জন্য এ কাজ করেছেন বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক ফার্দিন ফিশকে জামানত ছাড়া গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার আমদানি করতে ১৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এ ঋণে গ্রেস পিরিয়ড ছিল ১৬ মাস। পরে যা বাড়িয়ে ৫৫ মাস করা হয়েছে। সময়মতো গ্রাহক ট্রলার আমদানিও করেনি। একই শাখার আরেক গ্রাহক গ্রিন বাংলা স্পিনিং মিলস লিমিটেডের বিভিন্ন খাতে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ঋণ ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পুনঃতফসিল করেছে। এ গ্রাহকের কোনো অস্তিত্বই পাননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা।
বেসিক ব্যাংকের ঋণ অনিয়মে যে শাখাগুলো সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, গুলশান শাখা এর মধ্যে অন্যতম। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা সি ব্লু টেক্সটাইল নামের একটি কাগুজে কোম্পানিকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি খোলার সুযোগ দিয়েছে। একই শাখা ইউরো স্টার ট্রেডিংকে জামানত ছাড়া ২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে।
এছাড়া ব্যাংকটির নাটোর শাখা কৃষি ঋণের সুদ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে হিসাব করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপন্থী। সার্বিক মূল্যায়নে ব্যাংকটির ক্যামেলস রেটিং দাঁড়িয়েছে ৪। যা সবচেয়ে খারাপের আগের ধাপ।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির একজন মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়া হয়েছে, যাদের এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার কারণে সেগুলোর মালিকরা পলাতক। যে কারণে ঋণ আদায় বাড়েনি।
পুনঃতফসিল : ঋণ আদায় করতে না পারলেও ঋণ পুনঃতফসিল থেমে নেই। ২০১৬ সালে ২৫৯টি প্রতিষ্ঠানের ৭৮৮ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে বেসিক ব্যাংক। ২০১৫ সালে ২৯৬ প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল।
মামলাধীন ঋণ : ২০১৬ সালের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির দায়ের করা চলমান মামলার সংখ্যা ৩১৮টি। এসব মামলায় ২ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা আটকে আছে। এসব মামলার ১১৮টি ৫ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে, যাতে ২৮১ কোটি টাকা জড়িত। আর বাকি ২০০টি মামলার মেয়াদ ৫ বছরের কম। ব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মামলার সংখ্যা ১৪৮টি। এসব মামলায় আটকে আছে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা।
আগের যত অনিয়ম
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের শুরুতে বেসিক ব্যাংকের ৪ শাখায় বিশেষ পরিদর্শন চালায়। নানা অনিয়মের মাধ্যমে দিলকুশা শাখা থেকে ১৪০০ কোটি, গুলশান শাখা থেকে ১৫০০ কোটি এবং শান্তিনগর শাখা থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর আগে পরিদর্শন চালানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। নিয়মিত বিশদ পরিদর্শনেও নানা অনিয়মের ঘটনা বেরিয়ে আসে। বড় অঙ্কের আটকে যাওয়া ঋণ গুলশান শাখায় সিলভার কম ট্রেডিংয়ের ৩৫ কোটি, প্রফিউশন টেক্সটাইলের ১৫ কোটি, এসপিএন এন্টারপ্রাইজের ৫২ কোটি, শান্তিনগর শাখার হাসিব এন্টারপ্রাইজের ৩৬ কোটি, এসওএস ব্রাদার্সের ৪৫ কোটি, প্রধান শাখার আনোয়ার গ্রুপের ৬৫ কোটি, মৌলভীবাজারের চৌমুহনী শাখার ইমপেরিয়াল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ২৫ কোটি টাকা।
ওই পরিদর্শনে দেখা যায়, গুলশান শাখায় অনেক কোম্পানির চলতি হিসাব খোলার পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ঋণ অনুমোদন করে পর্ষদ। ২০১২ সালে ২ এপ্রিল শিফান শিপিং লাইন চলতি হিসাব খোলে। ৪ এপ্রিল ঋণ প্রস্তাব দিলে ৫ এপ্রিল পর্ষদ তা অনুমোদন করে। এ কোম্পানির ডিসেম্বরভিত্তিক ঋণ স্থিতি ছিল ৫৮ কোটি টাকা। একই শাখায় এস সুহি শিপিং লাইন, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, দিয়াজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ও এসজিএফ শিপিং লাইনের ঋণ প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রধান কার্যালয়ের চাহিদা অনুসারে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে পাঠান তারা। দিলকুশা শাখার গ্রাহক দি ওয়েল টেক্সের নামে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় ৩২ কোটি টাকা। এ থেকে ২২ কোটি টাকার দায় মেটাতে প্রিমিয়ার ব্যাংককে পরিশোধ করা হয়। ইব্রাহিম নিট নামে একটি কোম্পানির ঋণদায় প্রধান কার্যালয় কেনে ইউসিবিএল ও ওয়ান ব্যাংক থেকে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শান্তিনগর শাখায় ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠানকে ১৫২ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়, যার বিপরীতে জামানত একেবারেই অপ্রতুল। এলটিআরের বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির পর অনাদায়ে মেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়, যার স্থিতি ছিল ৫০ কোটি টাকা। এর মালিকের নাম ওয়াহিদুর রহমান। একই মালিকের অটো ডিফাইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ১৬৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১০ সালের ২ নভেম্বর। এর পরদিনই মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। নতুন মালিকের নাম আসমা খাতুন। একক ঋণসীমা যাতে অতিক্রম না করে তার জন্য ব্যাংকই এই কৌশল শিখিয়ে দেয়। ওয়াহিদুর রহমানের বেনামি প্রতিষ্ঠান এবি ট্রেড লিংককে ঋণপ্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন দেয় ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। অথচ শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর তারিখ ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। ব্যাংকের খাতায় কোম্পানির ঠিকানা বাসা ৭৫/এ, রোড নং ৫/এ, ধানমন্ডি। তবে সরেজমিনে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুলশান শাখায় মা টেক্স, এসপিএন ও ইএফএস এন্টারপ্রাইজের নামে কাগুজে মঞ্জুর করা ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী জনৈক শামীম চিশতি।
মূল হোতা পরিচালক পুরস্কৃত, ব্যাংকার জেলে, ব্যবসায়ী পলাতক : বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সবাই নিরাপদে আছেন। তারা ঘুরছেন-ফিরছেন, স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। পদ-পদোন্নতি দিয়ে সরকার উল্টো তাদের কাউকে কাউকে পুরস্কৃতও করেছে।
আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেসব ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে, তারা সবাই জামিনে। আদালত থেকে জামিন পেয়ে তাদের কেউ দেশে আছেন, কেউবা জামিন পাওয়ার দিনই পালিয়ে চলে গেছেন বিদেশে। অথচ পর্ষদের হুকুম তামিল করা ব্যাংকাররা অনেকেই এখন জেলে।
পর্ষদ সদস্যরা পুরস্কৃত : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছিল। সেই পর্ষদই ব্যাংকটিকে লুটপাটের মাধ্যমে ফতুর করেছে। ওই কমিটিতে পরিচালক পদে একই দিনে নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ২ মহাপরিচালক (ডিজি) শুভাশীষ বসু ও নীলুফার আহমেদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বিসিক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া বেসরকারি খাত থেকে পরিচালক হন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, সাবেক শুল্ক কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী আখতার হোসেন এবং এআরএস ল্যুভ বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম।
বেসিক ব্যাংক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুভাশীষ বসু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন রফতানি উন্নয়ন বোর্ডের (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান। কেলেঙ্কারির পুরো সময় তিনি ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি বাণিজ্যসচিব। ব্যাংকটির পরিচালক হওয়ার বছরেই বিজয় ভট্টাচার্যকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে সরকার নিয়োগ দেয়। জেনেভা থেকে দেশে ফিরলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন এবং বর্তমানে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান।
পর্ষদ সদস্য হওয়ার পর রাজিয়া বেগম পদোন্নতি পেয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। তবে ২০১০ সালের ৩১ জুলাই ব্যাংকের টুঙ্গিপাড়া শাখা উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সচিব রাজিয়া বেগম ও বিসিক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান।
অতিরিক্ত সচিব ফখরুল ইসলাম নতুন বিসিক চেয়ারম্যান হলে তাকে বেসিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর তাকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান। ব্যাংকের পরিচালক পদটিও তার থেকে যায়। পরে বিসিক চেয়ারম্যান হন ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য শ্যামসুন্দর সিকদার। পদোন্নতি দিয়ে তাকে করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব। বর্তমানে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব।
শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর ৫ বছরের মেয়াদে এ ছাড়া পরিচালক ছিলেন আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘মাসিক উত্তরণ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কামরুল ইসলাম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম রেজাউর রহমান। এর মধ্যে আনিস আহমেদ এখন উত্তরণ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। আর আবদুল হাইয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে রেজাউর রহমান চিঠি পাঠালে তিনি এবং কামরুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকে আর যেতেই পারেননি।
এআরএস ল্যুভের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার ৩ বছরের মধ্যে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। আগে তিনি যুবলীগের কোনো পদে ছিলেন না।
ব্যবসায়ীরা সব জামিনে : ফারসি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়জুন নবী চৌধুরী বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। দুদকের ২টি মামলায় ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ গ্রেফতার হন ফয়জুন নবী চৌধুরী। পরে নিম্ন আদালত থেকে তিনি জামিনের আবেদন করলে একই বছরের ২৫ মে তা নামঞ্জুর হয়। এরপর হাইকোর্ট থেকে ২ মামলায় ৬ মাসের জামিন নিয়ে ২০১৬ সালের ৩০ মে কারাগার থেকে ছাড়া পান ফয়জুন নবী। জামিন পেয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন। এর পর আর দেশে ফেরেননি ফয়জুন নবী। এশিয়ান শিপিং বিডির স্বত্বাধিকারী মো. আকবর হোসেনও আছেন জামিনে। একই ঘটনা ঘটে সৈয়দ হাসিবুল গণি ওরফে গালিবের বেলায়ও। এমারেল ড্রেস, এমারেল অটোব্রিকস, এমারেল কোল্ড স্টোরেজ এবং ভয়েস এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নেন ১৩২ কোটি টাকা। ৪টি আলাদা মামলার আসামি সৈয়দ হাসিবুল গণিও দুদকের হাতে গ্রেফতার হন ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ। একই কায়দায় তিনিও হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বিদেশে চলে গেছেন। এ ছাড়া ৬৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্য ভাসাভি ফ্যাশনের ইয়াসির আহমেদ খান, ৫৫ কোটি টাকার জন্য তাহমিনা ডেনিম ও তাহমিনা নিটওয়্যারের এমডি কামাল জামাল মোল্লা, ৮৫ কোটি টাকার জন্য এআরএসএস ইন্টারন্যাশনালের মো. সাবির হোসেন, ৩০ কোটি টাকার জন্য নাহার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। তবে তারা এ মুহূর্তে দেশে না বিদেশে আছেন তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
রূপসা সার্ভেয়ার কোম্পানির প্রধান সার্ভেয়ার (জরিপকারী) শাহজাহান আলী দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১৬ সালের আগস্টে। হাইকোর্টের মাধ্যমে তিনিও জামিনে আছেন।
শাহজাহান আলীর মামলার শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের যৌথ বেঞ্চ বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেন। এরপরই বাধ্য হয়ে আবদুল হাইসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়েছে দুদক। তবে বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু শুনানির সময় পরিবর্তনের আবেদন করে যাচ্ছেন। তিনি এখনো সময় দেননি বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
জেল খাটছেন ব্যাংকাররা : ব্যাংকার ২৭ জনের মধ্যে আবদুল হাই বাচ্চুর সব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকটির এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম পলাতক। তার আগের এমডি একেএম সাজেদুর রহমান ২০১০ সালের শেষ দিকে পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত এমডি হন তৎকালীন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শেখ মঞ্জুর মোরশেদ। কাজী ফখরুল ইসলাম এরপরই এমডি হয়ে আসেন। যাকে ২০১৪ সালের মে মাসে বরখাস্ত করা হয়। আসামিদের মধ্যে এই ৩জনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকাররা রয়েছেন। যাদের কেউ বরখাস্ত, কেউ চাকরিচ্যুত, কেউবা অপসারিত হয়েছেন।
দুদক ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকারদের মধ্যে গ্রেফতার করে ২ ডিএমডি মো. ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিমকে। একই মাসে গ্রেফতার হন গুলশান শাখার প্রধান শিপার আহমেদ। মার্চে সহকারী ব্যবস্থাপক ইকরামুল বারী এবং এপ্রিলে গ্রেফতার হন মহাব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন। ২ বছর পার হলেও তাদের কেউ জামিন পাননি। দুদকও চায় তারা জেলে থাকুক। যেমন ডিএমডি মো. সেলিম জামিন পেলেও গত ৭ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হয়েছে। গ্রেফতার না হওয়া ব্যাংকারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- বরখাস্ত হওয়া আরও ২ ডিএমডি এ মোনায়েম খান ও কনক কুমার পুরকায়স্থ, শান্তিনগর শাখাপ্রধান মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, গুলশান শাখাপ্রধান এসএম ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ।
ব্যাংক ও কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক লুট করা হয়েছে। যদি লুটের সঙ্গে জড়িত পর্ষদ সদস্যরা নিরাপদ থাকেন, ব্যবসায়ীরা জামিনে থাকেন আর ব্যাংকাররা জেলে থাকেন; এটাকে একটা টাইরানি, অলিগার্কি বা প্লুটোক্রাসি পরিস্থিতি আখ্যা দেওয়া যায়।’ তিন ইংরেজি শব্দের অর্থ করেছেন তিনি এভাবে-মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কারণে দুর্বল লোকদের পিষ্ট হওয়া।
সামগ্রিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ জড়িত পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করা ব্যাংক খাতের সুস্থতার জন্য জরুরি।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বেসিক ব্যাংকের মামলা নিয়ে বলেন, আদালত থেকে ব্যবসায়ীদের জামিন পাওয়া এবং ব্যাংকারদের জামিন না পাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। আর পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নেওয়া হচ্ছে। শেষ হওয়ার পর বোঝা যাবে তাদের অপরাধের ধরন কতটুকু। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ব্যাংক লুটপাট শক্তভাবে দেখা দরকার : হাইকোর্ট
ব্যাংক লুটপাটের বিষয় খুবই শক্তভাবে দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, পত্রপত্রিকায় যেভাবে ব্যাংক লুটপাটের খবর দেখছি, এগুলো খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে দেখা উচিত। তা নাহলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া আদালত দুদকের তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে বিশেষ করে অভিযোগপত্র দিতে দেরি হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন। বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলার ৩ আসামির জামিন আবেদনের শুনানিকালে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।
পরে বেসিক ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ফজলুস সোবহানসহ ৩জনকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেন আদালত। জামিনপ্রাপ্ত অপর ২জন হলেন- ব্যাংকটির গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক শিপার আহমেদ এবং ব্যাংক কর্মকর্তা মো. সেলিম। ৪ মামলায় ফজলুস সোহানকে এবং দুটি করে মামলায় অপর ২জনের জামিন মঞ্জুর করা হয়। শর্ত অনুযায়ী আদালতের কাছে তাদের পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া বিদেশে যেতে পারবেন না। তবে আরো মামলা থাকায় তারা জেল থেকে ছাড়া পাননি।
এসব আসামির জামিন আবেদনের শুনানিকালে আদালত আরও বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির পেছনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করেছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু নিজেই বলেছেন যে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির পেছনে একটি সিন্ডিকেট জড়িত। সিন্ডিকেট বলতে তিনি কাদের বোঝাচ্ছেন সেটি কিন্তু পরিষ্কার নয়।
ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার দায়ে প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোনায়েম খানকে চাকরিচ্যুত করা হয় ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর।

শীর্ষকাগজের সৌজন্যে:

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




বেসিক ব্যাংক ফতুর, ভালো আছে লুটেরাচক্র

আপডেট সময় : ০৩:৫১:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

২০০৯ থেকে গত কয়েক বছরে সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের ন্যায় রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকও হরিলুট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সরকারি এই ব্যাংকটি থেকে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি দুর্নীতিবাজ মাফিয়াচক্র। ২০১৪ সালে অনিয়ম ও লুটপাটের বিষয়টি প্রথমে প্রকাশ পায়। এর পর সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসে। পরিবর্তন আনা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায়। ২০০৯-১৩ সাল পর্যন্ত লাগামহীন লুটপাট, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দেড়শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলাও করে দুদক। ঘাটতি মেটাতে মূলধন সরবরাহ করে সরকার। তবে দুর্নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং এখনো অব্যাহত রয়েছে হরিলুট কা-। ফলে বারবার মূলধন সরবরাহ করে সরকার ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংকটির আমানতকারীরাও তাদের আমানত তুলে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এমন পরিস্থিতিতে লুট হওয়া অর্থ ফেরত আনতে না পারলে ব্যাংকটি রক্ষা করা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে বলে মত বিশ্লেষকদের। কিন্তু ঋণের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে দেয়া হয়েছে, যার কোনো অস্তিত্বই নেই। সঙ্গত কারণে, সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদসহ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও।
সূত্রমতে, বর্তমান সরকারের সময়ে লুটপাট হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি মেটাতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা মূলধন দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সহায়তা দিচ্ছে। এতে কোনো সুফল মিলছে না। ২০০৯-১৩ সালের মধ্যে দুর্নীতিতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটিতে ফের ঘটেছে অনিয়ম, লুটপাট ও ঋণ কেলেঙ্কারি। ফলে জনতা, সোনালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মতো বেসিক ব্যাংকটিও এখন ফতুর। অথচ সরকারি এই ব্যাংকটি লুটের মূলহোতা- ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ সাবেক পর্ষদ এবং ব্যবসায়ী নামের ব্যাংকলুটের মাফিয়াচক্র বেশ ভালোই আছেন। এর মধ্যে কেউ হয়েছেন পুরস্কৃত। কেউ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অর্থ-পাচারের পর নিজেরাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। তবে বেসিক ব্যাংকের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন কারাগারে আছেন। এ ক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাদের সখ্যতা তৈরির কথা বলে খোদ উচ্চ আদালত ‘লজ্জায় মুখ ঢাকার’ কথা বলেছেন। এমনকি এর পরও খুব একটা বদলায়নি দুদকের কার্যক্রম। ফলে বেসিক ব্যাংক লুটেরাদের আদৌ শাস্তি হওয়া ও লুট হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা থেকেই যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি লুটপাটের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গডফাদারদের কৌশলে আড়ালে রেখে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পর আদালতের নির্দেশে ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তা শেষ হয়নি। এ নিয়ে দুদক কর্মকর্তাদের ডেকে ভর্ৎসনা করেছেন আদালত। সেই সাথে সময়ও বেঁধে দেয়া হয়েছিল তদন্ত শেষ করতে। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময় চলতি বছরের জানুয়ারিতে পার হয়ে গেছে। তদন্ত শেষ হয়নি। কারণ, লুটেরাচক্র বড় শক্তি ও ক্ষমতাধর হওয়ায় তাদের কাছে দুদকও অসহায়। তাদেরকে জিজ্ঞাবাদের অনুমতি চেয়ে সময় পায় না দুদক। এ ক্ষেত্রে দুদক ‘ঠুটো জগন্নাথ’ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। আর ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসানে। অন্য সূত্র বলছে, ২০১৪ সালে প্রথমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট ধরা পড়ার পর ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও চলতি ২০১৮ সালেও ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকটিতে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থাৎ কোনোভাবেই অনিয়ম, দুর্নীতির লাগামটানা যাচ্ছে না সরকারি এই ব্যাংকটির। বরং নির্বাচনের বছরে এসে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্ম আরও বেপরোয়া গতি পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, দুর্নীতিতে ডুবন্ত বেসিক ব্যাংককে টেনে তোলার দায়িত্ব পাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান ব্যর্থ হয়েছেন। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করেছেন। এমডির হঠাৎ পদত্যাগের খবরে ফের নয়া সংকটে পড়েছে বেসিক ব্যাংক। এ অবস্থায় আমানতকারীরা আমানত তুলে নিতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন আশঙ্কার কাথা জানিয়েছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা। তবে অর্থমন্ত্রীর দাবি, এমডির পদত্যাগে কোনো সংকট দেখা দেবে না বেসিক ব্যাংকে।
এমডির পদত্যাগ
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান গত ১৪ আগস্ট পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তাকে এমডি পদে নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগ পেয়ে তিনি ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর ৩ বছরের জন্য বেসিক ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তার মেয়াদ ছিল। কিন্তু দুর্নীতিতে ডুবতে থাকা ব্যাংকটির চাপ নিতে না পেরে ১০ মাসের মধ্যে পদত্যাগ করলেন আউয়াল খান। ব্যাংকটিতে ইতিপূর্বে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটের পর ঋণের সুদহার কমানোর কারণে ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি করতে কর্মকর্তাদের কোনোরকমের সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না আউয়াল খান। তাই বাধ্য হয়ে মূলত পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শীর্ষকর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে বিভিন্ন সময়ে এমডির দেওয়া নির্দেশনাও পালন করেননি অনেক কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তারা অনেকে লুটেরা চক্রের সঙ্গে জড়িত। আর সেই কারণেই তাদের সঙ্গে এমডি আউয়াল খান পেরে উঠছিলেন না। তবে এমডির পদত্যাগে ‘বিচলিত নন’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, ‘এমডির পদত্যাগের কারণে বেসিক ব্যাংক নতুন করে কোনো সংকটে পড়বে না। পদত্যাগের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।’ ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
যেভাবে বেসিক ব্যাংক লুট
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রধান কার্যালয়ের সহযোগিতায় বেসিক ব্যাংকের গুলশান কার্যালয় থেকে ঋণের নামে এক দাগে ২৪৭ কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন আলোচিত মামা-ভাগ্নে। সিআইবি রিপোর্ট, বন্ধকী জমির মূল্যায়ন এবং এ বিষয়ে আইনজ্ঞের মতামত না নিয়েই মনিকা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৬৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা। ঋণ প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা রাজধানীর ঝিগাতলার মুন্সীবাড়ির ২৯/৯ নম্বর বাড়ি। এ ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায় একটি নির্মাণাধীন ভবন। এলাকাবাসীর মতে, নবনির্মিত এ ভবনের জমির মালিক অন্য একজন। সেখানে মনিকা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না কখনোই। জানা গেছে, ভবনটির মালিক মনিকা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মনির হোসেনের বড় ভাই সাবির হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, মনিকার মালিকের আপন ভাই সাবির হোসেনের প্রতিষ্ঠান এআরএসএস এবং ভাগ্নে হারিস মুহাম্মদ বিন মাকসুদের প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ গুলশান শাখার ১৭৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। এ ২টি প্রতিষ্ঠানও বেনামি ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেনি। খেলাপি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও সাবির হোসেনই মনির হোসেনের ঋণ হিসাবের শনাক্ত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের এক পরিদর্শনে দেখা গেছে, মামা-ভাগ্নে এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে আরেক কোম্পানিতে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছেন। ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের ২০১২ সালের ২৭ মার্চের প্রস্তাবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২৮ মার্চ ৬০ কোটি টাকার এসওডি ঋণ অনুমোদন করে। একইভাবে এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারির প্রস্তাবে ১৮ জানুয়ারি পর্ষদ ৫০ কোটি টাকার এসওডি, ১০ কোটি টাকার এলসি বা ঋণপত্র ও পাঁচ কোটি টাকার এলটিআর অনুমোদন করে। পরবর্তীকালে গ্রাহকের ১৯ এপ্রিলের আবেদনে শাখার একই দিনের প্রস্তাবে পরিচালনা পর্ষদ ওই দিনই এসওডি ৯৫ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা জানান, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ধানমন্ডির ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির একটি নামফলক থাকলেও তা মূলত আর্কেড রিয়েল এস্টেটের অফিস। এ ২টি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী একই ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটির নামে নেওয়া ঋণের অধিকাংশ অর্থই আর্কেড রিয়েল এস্টেটের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ অর্থ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে আরও দেখা যায়, গুলশান শাখায় এসএফজি শিপিং লাইন, এস সুহি শিপিং লাইন, শিফান শিপিং লাইন ও এস রিসোর্স শিপিং লাইনের নামে ২৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করা হয়নি এক টাকাও। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন জুয়েল নামে এক ব্যক্তি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এ ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে বলে। কিন্তু সর্বশেষ পরিদর্শনে দেখা যায়, জুয়েলের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ আদায় দূরের কথা, তার আরও একটি বেনামি প্রতিষ্ঠান সুরমা স্টিলকে নতুন করে ৬৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এভাবে ৩৩৮ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।
জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক ম্যানেজার শিপার আহমেদের সময় বেশিরভাগ অনিয়ম হয়েছে এবং কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। ঋণ বণ্টনের অনিয়ম-দুনীতির তথ্য ফাঁস হলে শাস্তির বদলে তাকে লাভজনক পদে পদোন্নতি দিয়ে বদলি করা হয়। এমনকি তাকে ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চতুরতার আশ্রয় নেয়। শিপার আহমেদ যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া ঋণ দিয়েছেন সেসব ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকেই। কারণ অন্য কোনো কর্মকর্তাকে ওই ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দিলে শিপার আহমেদের দুর্নীতির তথ্য আরও আগেই ফাঁস হয়ে যেত।
ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা কী?
সরকারের ক্ষমতার সুবিধাভোগী ও জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছর বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসময় ব্যাংকটির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৪ সালে পদত্যাগে বাধ্য হন বাচ্চু। ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পর্ষদও ঢেলে সাজানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এর পরও ২০১৬ পর্যন্ত সব ধরনের সূচকে অবনতি হয়েছে ব্যাংকটির।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ও হরিলুট হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বিশাল অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। তাছাড়া ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দানের অন্তরালে তা লুটপাট হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নামের লুটেরাদের যোগসাজশে। ফলে সরকারের তথা জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, বেসিক ব্যাংকের ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন শেষ হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। ১৯তম এ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও ৬৮টি শাখার কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয় ও ৫টি বড় শাখার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। ২০১৫ সালেও এরকম একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নানা সমস্যায় থাকার পরও এককালীন পরিশোধের (ডাউন পেমেন্ট) শর্ত পরিপালন না করেই বড় অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বৃদ্ধি, জামানত গ্রহণ না করে ঋণ প্রদান, যাচাই ছাড়া এলসি খোলা এবং কৃষি ঋণের সুদ হিসাবে অনিয়ম করেছে বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা। পর্ষদ পরিবর্তন হলেও নতুন করে ব্যাংকটির মূলধন পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে সরকার ৭৯০ কোটি ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করেছে। দু’বছরে সরকার ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন দেয়।
গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১৫ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। যা ১০ বছর আগে ছিল ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। তবে এ আমানতের ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা এসেছে মাত্র ১ হাজার ৪০১টি আমানত হিসাব থেকে। এসব হিসাবে ১ কোটি বা এর বেশি টাকা মেয়াদি আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে। এসব আমানতকারীর কয়েকজন আমানত তুলে নিলেই ব্যাংকটি বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
৪,৩১৯ কোটি টাকা লুট : ব্যাংকটি আয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই অনাদায়ী সুদও আয় খাতে দেখাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলশান শাখায় ৭টি প্রতিষ্ঠানের ১০টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা আয় দেখানো হয়েছে। যদিও এসব অর্থ আদায় হয়নি। এ পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক অনাদায়ী সুদ আয় খাতে নিতে নিষেধ করেছে। মোট হিসাবে ব্যাংকটির সুদ আয় ঋণাত্মক ৩১৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সামগ্রিকভাবে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪,৩১৯ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এই টাকা লুট করা হয়েছে।
বেড়েছে খেলাপি ঋণ : ১ বছরে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। ২০১৬’র ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। যা ২০১৫’র ডিসেম্বরে ছিল ৬ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ নগদ আদায়ও কম হয়েছে ব্যাংকটির। ২০১৫ সালে ব্যাংকটি ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে আদায় করেছে মাত্র ১৪০ কোটি টাকা। আর গত বছরে মাত্র ১২ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে ব্যাংকটি। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হিসাব বলছে, বেসিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।
থেমে নেই দুর্নীতি-লুটপাট : সীমাহীন অনিয়ম করে কয়েক বছর ধরে সমালোচনায় থাকা বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতিমূলক কর্মকা- থেমে নেই। ২০১৬ সালেও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা না করে অনেক কাজ করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬’র শেষের দিকে বেসিক ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা আমানত নিয়েছে। ব্যাংকের নিট সুদ আয় ঋণাত্মক হওয়া সত্ত্বেও বছরের শেষ দিকে এমনকি শেষ কার্যদিবসেও বিরূপ শর্তে অন্য ব্যাংক থেকে আমানত নিয়েছে বেসিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, ব্যাংকের স্বার্থরক্ষা না করে কৃত্রিমভাবে স্থিতিপত্রের আকার বাড়ানোর জন্য এ কাজ করেছেন বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক ফার্দিন ফিশকে জামানত ছাড়া গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার আমদানি করতে ১৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এ ঋণে গ্রেস পিরিয়ড ছিল ১৬ মাস। পরে যা বাড়িয়ে ৫৫ মাস করা হয়েছে। সময়মতো গ্রাহক ট্রলার আমদানিও করেনি। একই শাখার আরেক গ্রাহক গ্রিন বাংলা স্পিনিং মিলস লিমিটেডের বিভিন্ন খাতে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ঋণ ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পুনঃতফসিল করেছে। এ গ্রাহকের কোনো অস্তিত্বই পাননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা।
বেসিক ব্যাংকের ঋণ অনিয়মে যে শাখাগুলো সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, গুলশান শাখা এর মধ্যে অন্যতম। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা সি ব্লু টেক্সটাইল নামের একটি কাগুজে কোম্পানিকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি খোলার সুযোগ দিয়েছে। একই শাখা ইউরো স্টার ট্রেডিংকে জামানত ছাড়া ২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে।
এছাড়া ব্যাংকটির নাটোর শাখা কৃষি ঋণের সুদ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে হিসাব করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপন্থী। সার্বিক মূল্যায়নে ব্যাংকটির ক্যামেলস রেটিং দাঁড়িয়েছে ৪। যা সবচেয়ে খারাপের আগের ধাপ।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির একজন মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়া হয়েছে, যাদের এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার কারণে সেগুলোর মালিকরা পলাতক। যে কারণে ঋণ আদায় বাড়েনি।
পুনঃতফসিল : ঋণ আদায় করতে না পারলেও ঋণ পুনঃতফসিল থেমে নেই। ২০১৬ সালে ২৫৯টি প্রতিষ্ঠানের ৭৮৮ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে বেসিক ব্যাংক। ২০১৫ সালে ২৯৬ প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল।
মামলাধীন ঋণ : ২০১৬ সালের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির দায়ের করা চলমান মামলার সংখ্যা ৩১৮টি। এসব মামলায় ২ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা আটকে আছে। এসব মামলার ১১৮টি ৫ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে, যাতে ২৮১ কোটি টাকা জড়িত। আর বাকি ২০০টি মামলার মেয়াদ ৫ বছরের কম। ব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মামলার সংখ্যা ১৪৮টি। এসব মামলায় আটকে আছে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা।
আগের যত অনিয়ম
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের শুরুতে বেসিক ব্যাংকের ৪ শাখায় বিশেষ পরিদর্শন চালায়। নানা অনিয়মের মাধ্যমে দিলকুশা শাখা থেকে ১৪০০ কোটি, গুলশান শাখা থেকে ১৫০০ কোটি এবং শান্তিনগর শাখা থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর আগে পরিদর্শন চালানো হয় প্রধান কার্যালয়ে। নিয়মিত বিশদ পরিদর্শনেও নানা অনিয়মের ঘটনা বেরিয়ে আসে। বড় অঙ্কের আটকে যাওয়া ঋণ গুলশান শাখায় সিলভার কম ট্রেডিংয়ের ৩৫ কোটি, প্রফিউশন টেক্সটাইলের ১৫ কোটি, এসপিএন এন্টারপ্রাইজের ৫২ কোটি, শান্তিনগর শাখার হাসিব এন্টারপ্রাইজের ৩৬ কোটি, এসওএস ব্রাদার্সের ৪৫ কোটি, প্রধান শাখার আনোয়ার গ্রুপের ৬৫ কোটি, মৌলভীবাজারের চৌমুহনী শাখার ইমপেরিয়াল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ২৫ কোটি টাকা।
ওই পরিদর্শনে দেখা যায়, গুলশান শাখায় অনেক কোম্পানির চলতি হিসাব খোলার পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ঋণ অনুমোদন করে পর্ষদ। ২০১২ সালে ২ এপ্রিল শিফান শিপিং লাইন চলতি হিসাব খোলে। ৪ এপ্রিল ঋণ প্রস্তাব দিলে ৫ এপ্রিল পর্ষদ তা অনুমোদন করে। এ কোম্পানির ডিসেম্বরভিত্তিক ঋণ স্থিতি ছিল ৫৮ কোটি টাকা। একই শাখায় এস সুহি শিপিং লাইন, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, দিয়াজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ও এসজিএফ শিপিং লাইনের ঋণ প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রধান কার্যালয়ের চাহিদা অনুসারে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে পাঠান তারা। দিলকুশা শাখার গ্রাহক দি ওয়েল টেক্সের নামে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় ৩২ কোটি টাকা। এ থেকে ২২ কোটি টাকার দায় মেটাতে প্রিমিয়ার ব্যাংককে পরিশোধ করা হয়। ইব্রাহিম নিট নামে একটি কোম্পানির ঋণদায় প্রধান কার্যালয় কেনে ইউসিবিএল ও ওয়ান ব্যাংক থেকে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শান্তিনগর শাখায় ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠানকে ১৫২ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়, যার বিপরীতে জামানত একেবারেই অপ্রতুল। এলটিআরের বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির পর অনাদায়ে মেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়, যার স্থিতি ছিল ৫০ কোটি টাকা। এর মালিকের নাম ওয়াহিদুর রহমান। একই মালিকের অটো ডিফাইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ১৬৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১০ সালের ২ নভেম্বর। এর পরদিনই মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। নতুন মালিকের নাম আসমা খাতুন। একক ঋণসীমা যাতে অতিক্রম না করে তার জন্য ব্যাংকই এই কৌশল শিখিয়ে দেয়। ওয়াহিদুর রহমানের বেনামি প্রতিষ্ঠান এবি ট্রেড লিংককে ঋণপ্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন দেয় ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। অথচ শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর তারিখ ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। ব্যাংকের খাতায় কোম্পানির ঠিকানা বাসা ৭৫/এ, রোড নং ৫/এ, ধানমন্ডি। তবে সরেজমিনে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুলশান শাখায় মা টেক্স, এসপিএন ও ইএফএস এন্টারপ্রাইজের নামে কাগুজে মঞ্জুর করা ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী জনৈক শামীম চিশতি।
মূল হোতা পরিচালক পুরস্কৃত, ব্যাংকার জেলে, ব্যবসায়ী পলাতক : বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সবাই নিরাপদে আছেন। তারা ঘুরছেন-ফিরছেন, স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। পদ-পদোন্নতি দিয়ে সরকার উল্টো তাদের কাউকে কাউকে পুরস্কৃতও করেছে।
আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেসব ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে, তারা সবাই জামিনে। আদালত থেকে জামিন পেয়ে তাদের কেউ দেশে আছেন, কেউবা জামিন পাওয়ার দিনই পালিয়ে চলে গেছেন বিদেশে। অথচ পর্ষদের হুকুম তামিল করা ব্যাংকাররা অনেকেই এখন জেলে।
পর্ষদ সদস্যরা পুরস্কৃত : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছিল। সেই পর্ষদই ব্যাংকটিকে লুটপাটের মাধ্যমে ফতুর করেছে। ওই কমিটিতে পরিচালক পদে একই দিনে নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ২ মহাপরিচালক (ডিজি) শুভাশীষ বসু ও নীলুফার আহমেদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বিসিক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া বেসরকারি খাত থেকে পরিচালক হন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, সাবেক শুল্ক কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী আখতার হোসেন এবং এআরএস ল্যুভ বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম।
বেসিক ব্যাংক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুভাশীষ বসু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) থেকে পদোন্নতি পেয়ে হন রফতানি উন্নয়ন বোর্ডের (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান। কেলেঙ্কারির পুরো সময় তিনি ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি বাণিজ্যসচিব। ব্যাংকটির পরিচালক হওয়ার বছরেই বিজয় ভট্টাচার্যকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে সরকার নিয়োগ দেয়। জেনেভা থেকে দেশে ফিরলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন এবং বর্তমানে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান।
পর্ষদ সদস্য হওয়ার পর রাজিয়া বেগম পদোন্নতি পেয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। তবে ২০১০ সালের ৩১ জুলাই ব্যাংকের টুঙ্গিপাড়া শাখা উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সচিব রাজিয়া বেগম ও বিসিক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান।
অতিরিক্ত সচিব ফখরুল ইসলাম নতুন বিসিক চেয়ারম্যান হলে তাকে বেসিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর তাকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান। ব্যাংকের পরিচালক পদটিও তার থেকে যায়। পরে বিসিক চেয়ারম্যান হন ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য শ্যামসুন্দর সিকদার। পদোন্নতি দিয়ে তাকে করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব। বর্তমানে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব।
শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর ৫ বছরের মেয়াদে এ ছাড়া পরিচালক ছিলেন আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘মাসিক উত্তরণ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কামরুল ইসলাম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম রেজাউর রহমান। এর মধ্যে আনিস আহমেদ এখন উত্তরণ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। আর আবদুল হাইয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে রেজাউর রহমান চিঠি পাঠালে তিনি এবং কামরুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকে আর যেতেই পারেননি।
এআরএস ল্যুভের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার ৩ বছরের মধ্যে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। আগে তিনি যুবলীগের কোনো পদে ছিলেন না।
ব্যবসায়ীরা সব জামিনে : ফারসি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়জুন নবী চৌধুরী বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। দুদকের ২টি মামলায় ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ গ্রেফতার হন ফয়জুন নবী চৌধুরী। পরে নিম্ন আদালত থেকে তিনি জামিনের আবেদন করলে একই বছরের ২৫ মে তা নামঞ্জুর হয়। এরপর হাইকোর্ট থেকে ২ মামলায় ৬ মাসের জামিন নিয়ে ২০১৬ সালের ৩০ মে কারাগার থেকে ছাড়া পান ফয়জুন নবী। জামিন পেয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন। এর পর আর দেশে ফেরেননি ফয়জুন নবী। এশিয়ান শিপিং বিডির স্বত্বাধিকারী মো. আকবর হোসেনও আছেন জামিনে। একই ঘটনা ঘটে সৈয়দ হাসিবুল গণি ওরফে গালিবের বেলায়ও। এমারেল ড্রেস, এমারেল অটোব্রিকস, এমারেল কোল্ড স্টোরেজ এবং ভয়েস এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নেন ১৩২ কোটি টাকা। ৪টি আলাদা মামলার আসামি সৈয়দ হাসিবুল গণিও দুদকের হাতে গ্রেফতার হন ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ। একই কায়দায় তিনিও হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বিদেশে চলে গেছেন। এ ছাড়া ৬৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্য ভাসাভি ফ্যাশনের ইয়াসির আহমেদ খান, ৫৫ কোটি টাকার জন্য তাহমিনা ডেনিম ও তাহমিনা নিটওয়্যারের এমডি কামাল জামাল মোল্লা, ৮৫ কোটি টাকার জন্য এআরএসএস ইন্টারন্যাশনালের মো. সাবির হোসেন, ৩০ কোটি টাকার জন্য নাহার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। তবে তারা এ মুহূর্তে দেশে না বিদেশে আছেন তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
রূপসা সার্ভেয়ার কোম্পানির প্রধান সার্ভেয়ার (জরিপকারী) শাহজাহান আলী দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১৬ সালের আগস্টে। হাইকোর্টের মাধ্যমে তিনিও জামিনে আছেন।
শাহজাহান আলীর মামলার শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের যৌথ বেঞ্চ বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেন। এরপরই বাধ্য হয়ে আবদুল হাইসহ পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়েছে দুদক। তবে বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু শুনানির সময় পরিবর্তনের আবেদন করে যাচ্ছেন। তিনি এখনো সময় দেননি বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
জেল খাটছেন ব্যাংকাররা : ব্যাংকার ২৭ জনের মধ্যে আবদুল হাই বাচ্চুর সব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচিত ব্যাংকটির এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম পলাতক। তার আগের এমডি একেএম সাজেদুর রহমান ২০১০ সালের শেষ দিকে পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত এমডি হন তৎকালীন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শেখ মঞ্জুর মোরশেদ। কাজী ফখরুল ইসলাম এরপরই এমডি হয়ে আসেন। যাকে ২০১৪ সালের মে মাসে বরখাস্ত করা হয়। আসামিদের মধ্যে এই ৩জনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকাররা রয়েছেন। যাদের কেউ বরখাস্ত, কেউ চাকরিচ্যুত, কেউবা অপসারিত হয়েছেন।
দুদক ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকারদের মধ্যে গ্রেফতার করে ২ ডিএমডি মো. ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিমকে। একই মাসে গ্রেফতার হন গুলশান শাখার প্রধান শিপার আহমেদ। মার্চে সহকারী ব্যবস্থাপক ইকরামুল বারী এবং এপ্রিলে গ্রেফতার হন মহাব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন। ২ বছর পার হলেও তাদের কেউ জামিন পাননি। দুদকও চায় তারা জেলে থাকুক। যেমন ডিএমডি মো. সেলিম জামিন পেলেও গত ৭ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হয়েছে। গ্রেফতার না হওয়া ব্যাংকারদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- বরখাস্ত হওয়া আরও ২ ডিএমডি এ মোনায়েম খান ও কনক কুমার পুরকায়স্থ, শান্তিনগর শাখাপ্রধান মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, গুলশান শাখাপ্রধান এসএম ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ।
ব্যাংক ও কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক লুট করা হয়েছে। যদি লুটের সঙ্গে জড়িত পর্ষদ সদস্যরা নিরাপদ থাকেন, ব্যবসায়ীরা জামিনে থাকেন আর ব্যাংকাররা জেলে থাকেন; এটাকে একটা টাইরানি, অলিগার্কি বা প্লুটোক্রাসি পরিস্থিতি আখ্যা দেওয়া যায়।’ তিন ইংরেজি শব্দের অর্থ করেছেন তিনি এভাবে-মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কারণে দুর্বল লোকদের পিষ্ট হওয়া।
সামগ্রিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ জড়িত পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করা ব্যাংক খাতের সুস্থতার জন্য জরুরি।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বেসিক ব্যাংকের মামলা নিয়ে বলেন, আদালত থেকে ব্যবসায়ীদের জামিন পাওয়া এবং ব্যাংকারদের জামিন না পাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলার নেই। আর পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নেওয়া হচ্ছে। শেষ হওয়ার পর বোঝা যাবে তাদের অপরাধের ধরন কতটুকু। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ব্যাংক লুটপাট শক্তভাবে দেখা দরকার : হাইকোর্ট
ব্যাংক লুটপাটের বিষয় খুবই শক্তভাবে দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, পত্রপত্রিকায় যেভাবে ব্যাংক লুটপাটের খবর দেখছি, এগুলো খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে দেখা উচিত। তা নাহলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া আদালত দুদকের তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে বিশেষ করে অভিযোগপত্র দিতে দেরি হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেন। বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলার ৩ আসামির জামিন আবেদনের শুনানিকালে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।
পরে বেসিক ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ফজলুস সোবহানসহ ৩জনকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেন আদালত। জামিনপ্রাপ্ত অপর ২জন হলেন- ব্যাংকটির গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক শিপার আহমেদ এবং ব্যাংক কর্মকর্তা মো. সেলিম। ৪ মামলায় ফজলুস সোহানকে এবং দুটি করে মামলায় অপর ২জনের জামিন মঞ্জুর করা হয়। শর্ত অনুযায়ী আদালতের কাছে তাদের পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া বিদেশে যেতে পারবেন না। তবে আরো মামলা থাকায় তারা জেল থেকে ছাড়া পাননি।
এসব আসামির জামিন আবেদনের শুনানিকালে আদালত আরও বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির পেছনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করেছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু নিজেই বলেছেন যে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির পেছনে একটি সিন্ডিকেট জড়িত। সিন্ডিকেট বলতে তিনি কাদের বোঝাচ্ছেন সেটি কিন্তু পরিষ্কার নয়।
ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার দায়ে প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোনায়েম খানকে চাকরিচ্যুত করা হয় ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর।

শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: