মানসম্পন্ন আইপিও খরায় ধুঁকছে পুঁজিবাজার
- আপডেট সময় : ০৯:০৮:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ মার্চ ২০২০ ২৭৭ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক: মানসম্পন্ন আইপিও সংকটে গত কয়েক বছর ধরেই ধুঁকছে দেশের পুঁজিবাজার। সেকেন্ডারি মার্কেট নিয়ে তোড়জোড় থাকলেও আলোচনায় থাকছে না প্রাইমারি মার্কেট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাইমারি মার্কেটের উন্নতি ছাড়া শেয়ারবাজারের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, আইপিও বাজারের প্রাণ। তবে ত্রম্নটিযুক্ত নয়, দরকার ত্রম্নটিমুক্ত ভালো মানের আইপিও। আইপিও কম আসায় অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। অনেক ব্রোকারেজই খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। বাধ্য হয়ে কমানো হচ্ছে লোকবল। বছরে যেখানে ১৮ থেকে ২০টি আইপিও অনুমোদন পাওয়া যেত এখন তা দাড়িয়েছে ২ থেকে ৩টিতে। সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া ২ টি আইপিও বাদ দিলে গত আট মাসে আইপিও সংখ্যা শূন্য। গত ৮ বছরে ডিএসইতে অনুমোদন পাওয়া ৫৩ শতাংশই লোকসানে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যারা অনুমোদন পেয়েছে তাদের অবস্থা বোঝা যাবে ২০২১ সাল নাগাদ।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, কমিশন আইপিও প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাপূর্ণ করেছে। কমিশনের একটি চেকলিস্ট আছে যা পূরন করতে পারলেই কেবল আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়। অনেক আইপিও আবেদন কমিশনের কাছে পড়ে আছে অধিকাংশই চেকলিস্ট পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও কমিশন সময়ক্ষেপণ করে না। ইসু্য ম্যানেজার ও ডিএসইতেই আইপিও অনেক দিন প্রক্রিয়াধীন থাকে।
নাম প্রকাশে অনইচ্ছুক কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, প্রক্রিয়া আগের চেয়ে কঠিন হওয়ায় বাজারে নতুন আইপিও আসছে না। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বহু আইপিও এর আগে কমিশনের অনুমোদন পেয়েছে। পরবর্তিতে এরাই শেয়ার বিক্রি করে মার্কেট থেকে বের হয়ে গেছে। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি খারাপ থাকায় কমিশন এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে আছে। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে বলা মুশকিল। তবে আইন যদি সবার জন্য সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়, সব কোম্পানির আইপিও যদি একইভাবে সঠিক নিয়ম ও শর্ত মেনে আসে তাহলে মার্কেটে স্বাভাবিক হতে বাধ্য।
২০০০ সালের পর বড় পরিবর্তন আসে আইপিও আইনের। বর্তমানে এক্ষেত্রে আরও কঠোর হয়েছে কমিশন। বর্তমানে প্রতিটি আইপিওর ক্ষেত্রে দিতে হয় প্রায় ৪০০টি তথ্য ও পূরণ করতে হয় প্রায় ২৯৬ শর্ত। এরপরও ভালো কোম্পানি ঘাটতি রয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদে গতিশীল করতে আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) প্রক্রিয়াকে আরো সহজ ও স্বচ্ছতা আনা জরুরি। এক্ষেত্রে কমিয়ে আনতে হবে বিদ্যমান সময়সীমা। এছাড়া আস্থা বাড়াতে সচ্ছ করতে হবে কোম্পানির অডিট বা নিরীক্ষা প্রতিবেদন। পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় জড়িত সবার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতে সিকিউরিটি কমিশকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পুঁজিবাজারে অস্থিরতা চলছে তার জন্য আইপিও প্রক্রিয়া দায়ী উলেস্নখ করে তিনি বলেন, এখন আইপিওতে নজর দিতে হবে। বাজার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু পরিস্থিতিতি স্বাভাবিক করতে হলে আইপিও সংস্কার খুব জরুরি। শুধু সেকেন্ডারি মার্কেট নিয়ে ভাবলে হবে না।
বাজারে কোয়ালিটি সম্পন্ন কোম্পানি প্রসঙ্গে ছায়েদুর রহমান বলেন, কোয়ালিটিসম্পন্ন কোম্পানির কথা বলা হচ্ছে। আসলে এই ধরনের কোম্পানির একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা দরকার। নইলে কমিশনের এই ধারণাটি অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডিএসইতে ৯৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, যার বড় অংশই মানহীন। আর এই ৮ বছরে যতগুলো আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার ৫৩ শতাংশের আয় কমে গেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ আইপিও এসেছে মাত্র ৪টি মার্চেন্ট ব্যাংকের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এসব আইপিওর একটা বড় অংশ বন্ধ হয়ে গেছে অথবা লোকসানে পড়েছে। যদিও প্রায় ৪০টির মতো কোম্পানি আছে যারা বাজারে আইপিও আনে। আইপিওতে আসার আগে কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। কখনো আবার আইপিওতে অর্থ সংগ্রহের পরপরই বোনাস ইসু্যর মাধ্যমে মূলধন বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিবেদন ও উলিস্নখিত সম্পদ বিবরণীতে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। অধিকাংশেরই অডিট রিপোর্টের সাথে গরমিল রয়েছে প্রদানকৃত তথ্যের।
এদিকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারে সব মহল থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যহত থাকা সত্ত্বেও সুফল পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৭ লাখ ১৮ হাজার বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব কমে গেছে। বর্তমানে যে বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার মধ্যে ৫৫ শতাংশে কোনো শেয়ার নেই। শুধু গত এক বছরেই ৩০ হাজারের বেশি স্বক্রিয় বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন।
অভিযোগের তীর ইসু্য ম্যানেজারদের দিকে। কারণ তাদের হাত ধরেই নিম্নমানের আইপিওগুলো বাজারে এসেছে। এই কোম্পানিগুলো শুরুতে যে আয় দেখায়, অর্থ সংগ্রহের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে আইপিও অনুমোদন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কমিশন। তাই কয়েকে দফা আইন সংশোধন পাশাপাশি সিকিউরিটি কমিশন কড়া নজর দিয়েছেন আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে পালনীয় শর্ত বা চেকলিস্টের দিকে। এক্ষেত্রে ইসু্য ম্যানেজারদের জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে বলে মনেকরেন বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
সংশ্লিষ্টদের মতে নতুন আইপিও আসলে জমজমাট একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে। নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি বাড়ে বিনিয়োগকারী। অন্যদিকে কোম্পানিও তার শর্তনুযায়ী মুনাফার স্বদব্যাবহার করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে ভাল মানের আইপিওর কোন বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবুল বারাকাত বলেন, বাজারে মান উন্নয়নে সঠিক আইপিও আনা দরকার। খারাপ মানহীন আইপিও এনে প্রতারিত হওয়ার চাইতে মানসম্পন্ন দু’একটি আইপিও অনেক ভাল।
সিকিউরিটি কমিশনের কড়া শর্তের কারনে কি আইপিও আসছে না ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বহুজাতিক বাদ দিয়েও দেশে অনেক কোম্পানি আছে যারা পুঁজি বাজারে আসতে ইচ্ছুক না। এর জন্য দুটি কারণ থাকতে পারে, এক মার্কেট পরিস্থিতি ভালো না তাই ঝুঁকি নিতে কেউ রাজি না। আর দ্বিতীয়টি হলো, পুজিবাজারে বিনিয়োগের পর্যায়ে এখনো কোম্পানিগুলো এসে পৌঁছায়নি। মূলত বড় পরিসরে বিনিয়োগের মত কোম্পানির সংখ্যা সত্যিকার অর্থেই দেশে অনেক কম। এছাড়াও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ট্র্যাডিশন দেশীয় কোম্পানি মধ্যে এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি।
এই অর্থনীতিবীদের মতে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সাথে শিল্পায়েনের একটা ফান্ডামেন্টাল সম্পর্ক আছে। আমরা শিল্পায়েনের প্রাথমিক ধাপে রয়েছি। এখনো দেশে কোন হেবি শিল্প গড়ে ওঠেনি। পদ্মা সেতু বা কর্নফুলি র্টানেলের সমমানে দেশে কোন শিল্প কারখানা নেই। তাই ব্যবসায়ীদের পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ কম। এখনো প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানেই বিনিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের আরও ১০ থেকে ১৫ বছর লাগবে শিল্পায়নের এই ধাপ পেরতে। তখন শেয়ার মাকের্টে আইপিও ঘাটতি থাকবে না, কম করে হলেও ৭০ ভাগ দেশীয় বড় কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে নেই কিংবা কম আইপিও আসছে এসব নিয়ে বেশি ইমোশনাল না হওয়াই ভালো। কারণ শেয়ার বাজার এলিটদের বাজার আর তাই এলিট কোম্পানি সংখ্যা না বাড়া পর্যন্ত বাজার স্থিতিশীল না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
সকালের সংবাদ ।