শামীমা নূর পাপিয়ার উত্থান যেভাবে
- আপডেট সময় : ০৯:৪৫:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ ১৩৪ বার পড়া হয়েছে
নরসিংদী প্রতিনিধি |
নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। তবুও স্বল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। পাপিয়ার স্বামী সুমনের বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী ১০-১২ বছর আগেও একজন গানমাস্টার ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গান শিখিয়ে যা রোজগার করতেন তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম পোহাতে হতো। বর্তমানে তার ছেলে সুমনের রাজধানীর ফার্মগেটের ২৮ ইন্দিরা রোডে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও ব্যক্তিগত গাড়ি, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট এবং বাগদী এলাকায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট রয়েছে।
নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দীস্থ মহল্লায় তার চারতলা একটি অত্যাধুনিক বাড়ি রয়েছে। যদিও বাড়িটি বর্তমানে তালাবদ্ধ। অপরদিকে শহরের ভাগদী এলাকায় পাপিয়ার দোতলা বাড়ি থাকলেও সেটিও তালাবদ্ধ রয়েছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে সুমন-পাপিয়া ঢাকায় চলে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মাঝে মধ্যে নরসিংদীতে এসে অংশ নিত। তাছাড়া সুমন বিভিন্ন সময় গাড়ি বহরে করে নরসিংদী আসত। নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হাসান জানান, সুমনের বিরুদ্ধে আগের দুটি মামলা ছাড়া নতুন কোনো মামলা নেই।
গতকাল সোমবার তিন মামলায় পাপিয়া ও তার স্বামীকে ১৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমানের আদালত।
অভিযোগ রয়েছে, নরসিংদীতে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চাকরি দেয়ার প্রলোভনে আর্থিক প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স প্রদান, গ্যাসলাইন সংযোগ দেয়ার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন পাপিয়া। এমনকি পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নামেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন পাপিয়া-সুমন দম্পতি।
রাজনীতির অন্তরালে অস্ত্র, মাদক ও দেহ ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা জানাজানি হলে পাপিয়া ও তার স্বামী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমনকে নিয়ে নরসিংদীজুড়ে চলছে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল পাপিয়ার ভিডিও। নারী নেত্রীর অন্তরালে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বের হতে শুরু হয়েছে।
পাপিয়া ও সুমনের নেপথ্যের কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর বিষয়টি এখন নরসিংদীতে ‘টপ অব দ্য টাউন’। এরই মধ্যে রোববার সকালে র্যা ব-১ এর একটি তদন্ত টিম নরসিংদী শহরের ভাগদীস্থ পাপিয়ার বাবার বাড়ি ও পশ্চিম ব্রাহ্মন্দীস্থ শ্বশুড়বাড়ি অভিযান চালায়। এছাড়াও র্যাববের আরেকটি দল ঢাকায় তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্লাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। সুমন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিককে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর সুমন আলোচনায় আসেন। এরপর সুমন পাপিয়াকে বিয়ে করেন। তারপরই স্ত্রী পাপিয়াকে রাজনীতিতে কাজে লাগান।
এলাকায় অভিযোগ আছে, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী নরসিংদী এলাকায় ‘কিউ অ্যান্ড সি’ নামের একটি ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করতেন। যাদের মাধ্যমে নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, মাসোহারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন।
কয়েক বছর আগে পাপিয়ার উপস্থিতিতে তার স্বামী সুমন নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসার পর সে সুস্থ হলে এরপর থেকে সে নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমায়।
নরসিংদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ৯-১০ বছর আগে থেকেই পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনের চলাফেরা সন্দেহজনক ছিল। তখন থেকেই তাদেরকে আমরা নরসিংদীর রাজনীতি থেকে বিদায় করে দিয়েছি। বর্তমানে এমপি নজরুল ইসলাম হিরুর হাত ধরে নরসিংদীতে আবির্ভাব হয়েছে।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন ভূঁইয়া বলেন, যুব মহিলা লীগের কোনো অস্তিত্ব নেই। নরসিংদী আওয়ামী লীগের কোনো নেতার সাথে আলোচনা বা পরামর্শ ছাড়াই এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাধা দেওয়ার পরও কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল পাপিয়াকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে দেয়। যদি জেলা আওয়ামী লীগের পরামর্শ নিয়ে জেলা যুব মহিলা লীগ কমিটি গঠন করা হতো, তাহলে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটতো না। দলের নাম ভাঙিয়ে পাপিয়ার অসামাজিক কার্যকলাপ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের ফলে আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বর্তমান সাংসদ লেঃ কর্নেল (অবঃ) নজরুল ইসলাম হিরু বলেন, সুমন সাবেক কমিশনার মানিক হত্যায় সম্পৃক্ত বলে শুনেছি। তার সাথে ছবি ওঠানো প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও রাষ্ট্রপ্রতি মোঃ আবদুল হামিদ-এর সাথে পাপিয়ার ছবি আছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে পাপিয়াকে মহিলা আওয়ামী যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক বানানোর সময় আমি ও বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কেন্দ্র থেকে পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।