সকালের সংবাদ ডেস্ক;
রবিউল একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। লেখাপড়া করেছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। পড়ালেখা শেষ করে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় বিক্রি করছেন খাঁটি মধু, ঘি, কালোজিরার তেল। বিক্রির তালিকায় আরো আছে পোড়াবাড়ির চমচম, দই, রসমালাই, বালিশ মিষ্টি, মন্ডা ইত্যাদি বগুড়া, কুমিল্লা, নেত্রকোনা মুক্তাগাছার, টাঙ্গাইলের থেকে সহ বিভিন্ন স্থানখেকে এগুলা সংগ্রহ করে ফুটপথে বিক্রি করে। চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেই কিছু করবে এবং নিজেই একদিন মানুষকে চাকরি দিবেন বলে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
ব্যবসার শুরুর দিকের সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন পথচারীদের কাছে শুনতে হয়েছে নানা কটু কথা। তারপরেও থেমে যাননি। অদম্য ইচ্ছে শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজ স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণের পথে। স্বপ্ন দেখেন তিনি বাংলাদেশে সব খাবার একদিন ভেজালমুক্ত হবে এবং সমাজ থেকে বেকার সমস্যা দূর করার। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পড়াশোনা শেষ করেই নিজ উদ্যোগেই শুরু করেন(সহজসরল ডটকম) নামে এই মিষ্টি ও মধু বিক্রির ব্যবসা। নিজে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনে অর্ডার করার মাধ্যমে এসব খাবার ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন বেশ কয়একবছর যাবৎ।
তার সঙ্গে কথা হয় গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা বর্তমানে থাকেন রাজধানীর মিরপুর এলাকায়। বাবা একজন কৃষক আর মা গৃহিণী। কথার মাঝে জানালেন, তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কুমিল্লাতেই। স্কুলে পড়া অবস্থায় তার ইচ্ছে জাগে দেশর কিছু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। দেশের জন্য কিছু করতে চায়। সে বলে আমার বড় ভাই সৌদি থাকেন আমাদের কুমিল্লার বেশির ভাগ মানুষই প্রবাসে কাজের জন্য যায়। সেখানে গিয়ে শ্রমিকের কাজই তারা করে থাকেন। বিদেশে গিয়ে যে কাজ করে, সেই কাজই নিজ দেশে করতে লজ্জা পায়। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবো কিন্তু দেশেই থেকে সেই সিদ্ধান্তার কারনে চাকরি না করে ব্যবসা করে ভেজাল মুক্ত খাবার সবার কাছে পৌছে দিতেই ব্যবসা শুরু করেছি।
কুমিল্লাতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংএ ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকায় আসেন। ভর্তি হন ড্যাফোডিল ইউনিভারসিটির সিইসিতে। ঢাকায় আসার পর যে খাবারই কিনে খাচ্ছিলেন তিনি, কোনো কিছুতেই স্বাদ পাচ্ছিলেন না। ভেজাল খাবারে ভরপুর ঢাকা শহরের কোনো খাবার খেয়ে তিনি তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। এরই মাঝে সিইসিতে অনার্স শেষ করেন। পড়াশোনা শেষ করে দেশ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার সেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে সিদ্ধান্ত নেন চাকরির না করে ব্যবসা করবেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবেন।
ব্যবসার সকল পরিকল্পনা মাথায় থাকলেও তার কাছে ব্যবসা করার মতো তেমন টাকা ছিল না। ঠিক তখন এক আত্মীয়ের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। ধার করা টাকা থেকে ত্রিশ হাজার টাকায় কিনেন একটি ফ্রিজ। ভালো ব্যবসা করার মতো তেমন কোনো টাকা না থাকায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে নিজ উদ্যোগে সহজসরল ডটকম নামে অনলাইনে মিষ্টি বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন।পাশাপাশি ফুটপাথে কুমিল্লার রসমালাই ও টাঙ্গাইলের চমচম কিনে এনে রাস্তায় রাস্তায় তিনি বিক্রি করা শুরু করেন।
অনেকে বলে লেখাপড়া করার কি দরকার ছিল যদি রাস্তায় মিষ্টিই বিক্রি করবি। আবার কেউ বলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পড়ুয়াদের নাকি আমি চাকরীর জন্য নিরুৎসাহ করছি। এমনই নানা কথা শুনতে হয়েছে যখন রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি বিক্রি শুরু করি। প্রথম ৬ মাস কেউই পাশে ছিল না। অনেকটা একা একা কাজ করতে হয়েছে। চারদিক থেকে শুধু কুটুক্তি শুনেছি। আমি সবাইকে বলতে চাই লেখাপড়া করলে কি চাকরি করতেই হবে?
৬ মাস ব্যবসা করে তেমন লাভে না পেয়ে মিষ্টি বিক্রি বন্ধ রেখে কাপড় বিক্রির শুরু করি। রাস্তায় রাস্তায় ১০০ টাকার টি-শার্ট বিক্রি করেছি এক মাস। কাপড় ব্যবসায় ভালোই লাভ হয়, তবে মন বসেনি। এরপর আবার ভেজালমুক্ত খাবার সরবাহ করার ব্যবসায় ফিরে আসি, বিভিন্ন মানুষ সাড়া দেয়। অনলাইনেও ভালোই অর্ডার পেতে থাকি। এবার নির্ভেজাল খাবার সরবরাহ করার সংগ্রাম আবার শুরু করি।
তিনি বলেন, পর্যাপ্ত টাকা ছিল না তাই নিজেই মার্কেটিং এর জন্য রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি, মধু, কালজিরার তেল বিক্রি করার কাজ করি। ঢাকার খামার বাড়ি, পান্থপথ, গ্রীনরোড, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, ধানমন্ডি, সোবহানবাগ, কাওরান বাজার, মতিঝিল সহ অনেক ব্যস্ততম পয়েন্টে সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। অনবরত রাস্তায় দাড়িয়ে ছিলাম। একটা টেবিল, ১/২ প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে। বিশ টাকা পিছ চমচম বিক্রি করেছি। সেই সঙ্গে লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড বিলি করেছি পরবর্তীতে যতে অর্ডার করতে পারে ক্রেতারা।
তিনি বলেন স্বপ্ন দেখি “সহজসরল ডটকম” একদিন দেশের বড় ব্র্যান্ড হবে। এই কোম্পানিতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কাজের মাধ্যমে তরুণদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি যেন বেকার না থেকে কিছু একটা করে। চাকরির পেছনে ঘুরে ঘুরে সময় যেন নষ্ট না করে। যার চাকরি করে তারা অবশ্যয় চাকরি করবে তবে চাকরি না পেয়ে বেকার ঘুরে বেড়ানো বোকামি। তাই চাকরি না পেলে কিছু একটা করতে হবে হতাশ হওয়া উচিৎ নয়।
বর্তমানে কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বগুড়ার দই, মুক্তাগাছার মন্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, খাঁটি ঘি, মেহেরপুরের রস কদম, মধু ও কালোজিয়ার তেল সরবাহ করে আসছেন তিনি। অনলাইনে অর্ডার করা যায় এসব খাবার। প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান রবিউল। বর্তমানে ভেজালমুক্ত খাবার সরবাহের পাশাপাশি বেকার তরুণদের নানাভাবে ব্যবসায়িক পরামর্শ দিয়ে আসছি। একদিন কোনো মানুষই বেকার থাকবে না বাংলাদেশে। কোনো না কোনো কাজে সবাই যুক্ত থাকবে। ’বাংলাদেশ একদিন ‘নির্ভেজাল খাদ্য ও বেকারমুক্ত’ দেশে পরিণত হবে এমনটাই আশা।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকাসহ সব জেলাতে নূন্যতম একটি হলেও শাখা করব। দুধ, বিশুদ্ধ পানি, মৌসুমি ফল, ফরমালিনমুক্ত সবজি, ফরমালিন মুক্ত মাছ, মিষ্টি, মধু, কালজিরার তেল, ঘি সহ সকল খাবার নিয়ে কাজ করব। যেখান থেকে নির্ভেজাল খাবার সরবরাহ করবো ক্রেতাদের কাছে। আর সেই সঙ্গে সারাদেশে আমি একটি সেচ্ছাসেবী টিম গড়ে তুলতে চাই। বেকারত্ব থেকে উঠে আসতে তরুণদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশকরে চাকরি না করে ব্যবসা এবং দেশের মানুষের সেবা করা যায় একদিন সবাইকে দেখিয়ে দিবো।