ঢাকা ০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার! Logo ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোর সংস্কার শুরু Logo বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মানববন্ধন Logo কুবি উপাচার্যের বক্তব্যের প্রমাণ দিতে শিক্ষক সমিতির সাত দিনের আল্টিমেটাম




৩০ বছর আগের খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন, চার আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:১৮:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০১৯ ১২৭ বার পড়া হয়েছে

অনলাইন ডেস্ক; 

একজন রিকশাচালকের তথ্যে ত্রিশ বছর আগের ঢাকার একটি চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন প্রকৃত আসামি। যারা ইতিমধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সগিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এঁরা হলেন মারুফ রেজা, আনাস মাহমুদ, আনাসের দুলাভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন (আনাসের বোন)।

সেই রিকশাচালকের নাম ছালাম মোল্লা। বর্তমানে তাঁর বয়স ৫৬ বছর। খুনের ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৬ বছর। ছালামের সামনে ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হন।

খুনিদের চেহারা কেমন ছিল? কী কথা হয়েছিল খুনিদের সঙ্গে? কীভাবে সগিরা মোর্শেদকে খুন করা হয়? খুনের পর খুনিদের ধরার জন্য তিনি পিছু নিয়েছিলেন—এসব তথ্য ঢাকার আদালতকে চলতি সপ্তাহে বিস্তারিত জানান রিকশাচালক ছালাম মোল্লা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং খুনিদের চিহ্নিত করতে রিকশাচালক ছালাম মোল্লার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর সামনেই সগিরা মোর্শেদকে খুন করা হয়। ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক ছালাম।\

কী ঘটেছিল সেদিন
মামলার কাগজপত্র ও পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, সগিরা মোর্শেদ ও তাঁর স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর। তাঁদের তিন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। রাজারবাগের একটা বাসায় বসবাস করতেন।

১৯৮৯ সালে এই দম্পতির মেয়ে সারাহাত সালমার বয়স ছিল আট বছর। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য রাজারবাগের বাসা থেকে সেদিন বিকেল ৫টায় রওনা হন সগিরা। রাজারবাগ মোড় থেকে চার টাকায় রিকশাচালক ছালামকে ভাড়া করেন। ছালাম মালিবাগ পেট্রল পাম্প থেকে শান্তিনগর মোড় দিয়ে ভিকারুননিসা স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সগিরা অল্প সময়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য মৌচাকের গলি দিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। সগিরার কথা অনুযায়ী, ছালাম মৌচাকের গলি পার হয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে যাচ্ছিলেন। স্কুলের অদূরে রিকশার গতিরোধ করে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের দুজন লোক ছিল। একজন ছিলেন লম্বা, তাঁর মুখ লম্বাকৃতির। গোঁফ ছিল পাতলা। আরেকজন ছিলেন খাটো, ভালো স্বাস্থ্যবান। তখন মোটরসাইকেল থেকে নেমে সগিরার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় একজন। আর বাঁ হাতের চুড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকে। তখন সগিরা মোর্শেদ ওই লোকটির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু তোমাকে চিনি।’ সগিরাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়। যা তাঁর বুকের বাম পাশে লেগে বুক ভেদ করে। গুলির শব্দ শোনার পর স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন ফাঁকা গুলি করে শান্তিনগরের দিকে পালিয়ে যায় তাঁরা। তখন রিকশাচালক ছালাম ‘হাইজেকার, হাইজেকার’ বলে চিৎকার দিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকেন। শান্তিনগরের মহিলা সমিতির অফিসের সামনে পর্যন্ত যান। কিন্তু ততক্ষণে খুনিরা পালিয়ে যান। এরপর সগিরা মোর্শেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন।

মামলার কাগজপত্র এবং পিবিআইয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলার তদন্ত ভার পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। সগিরা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মিন্টু নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারও শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ছয়জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। সাক্ষীরা তখন আদালতের কাছে মারুফ রেজা নামের এক ব্যক্তির নাম জানান। যিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে সাক্ষীরা জানান। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করার আবেদন করেন। আদালত তাতে সায় দেন। বিচারিক আদালতের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আসেন মারুফ রেজা। এরপর চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলাটি ২৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। গত ১১ জুলাই হাইকোর্ট পিবিআইকে অধিকতর তদন্ত করার নির্দেশ দেন।

কেন এই খুন
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রিকশাচালক ছালাম। তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। এরপর তাঁকে খুঁজে বের করেন। তাঁর দেওয়া তথ্য এবং সগিরার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, সগিরার খুনের ঘটনার প্রকৃত কারণ।

ঢাকার আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে পিবিআই বলেছে, সগিরা মোর্শেদের স্বামীর নাম আবদুস ছালাম চৌধুরী। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম সামছুল আলম চৌধুরী। মেজো ভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী। তিনজনই তাঁদের পরিবার নিয়ে আউটার সার্কুলার রোডে তখন বসবাস করতেন। সগিরা মোর্শেদরা থাকতেন দ্বিতীয় তলায়। চিকিৎসক হাসান তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনকে নিয়ে থাকতেন ওই বাসার তৃতীয় তলায়। শাহীন তিন তলা থেকে প্রায় সময় ময়লা-আবর্জনা ফেলতেন, যা সগিরা মোর্শেদের পেছনের রান্না ঘর ও সামনের বারান্দায় পড়ত। এ নিয়ে সগিরার সঙ্গে মাহমুদার প্রায় ঝগড়াঝাঁটি হতো। আর শাশুড়ি থাকতেন সগিরার সঙ্গে। তাঁর শাশুড়ি তাঁকে ভালোবাসতেন। এ নিয়ে চিকিৎসক হাসানের স্ত্রী মাহমুদা খুব হিংসা করতেন। ঝগড়ার সময় সগিরাকে মাহমুদা বলতেন, ‘দাঁড়া, আমার ভাই রেজওয়ান (আনাস মাহমুদ) আসুক। আমার ভাইকে দিয়ে তোকে মজা দেখাব। তোকে ঘর থেকে বের করব।’

পিবিআই বলছে, পারিবারিক তুচ্ছ কারণ হাসান আলী ও তাঁর স্ত্রী মাহমুদার মনে ইগোর জন্ম হয়। এক সময় মাহমুদা সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর স্বামী হাসানকে বলেন। হাসান তাতে রাজি হন। চিকিৎসক হাসানের রোগী ছিলেন মারুফ রেজা। যিনি তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সন্ত্রাসী ছিলেন। আর এই মারুফ ছিলেন সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের আত্মীয়। সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফের সঙ্গে কথা বলেন চিকিৎসক হাসান। ওই কাজের জন্য মারুফকে তখন ২৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন হাসান। আর হাসান তখন মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ করেন তাঁর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে। যাতে সগিরাকে সহজে দেখিয়ে দিতে পারেন। আনাস তাঁর দুলাভাই হাসানের বাসায় যাতায়াত করতেন। যে কারণে তিনি সগিরাকে চিনতেন।

পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, হাসান সেদিন তাঁর শ্যালক আনাস মাহমুদকে বেলা দুইটায় ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন। মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসবেন বলে জানান। হাসান তাঁর শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরাকে দেখিয়ে দিতে বলেন। মারুফ রেজার মোটরসাইকেলে করে সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের গলি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডে ঢোকেন আনাস মাহমুদ। সগিরা মোর্শেদের রিকশা অনুসরণ করে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে থাকেন। মারুফ মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরার রিকশা গতিরোধ করেন। সগিরার হাত ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে নেন মারুফ এবং হাতের চুড়ি ধরে টানা হিঁচড়া করেন। তখন আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলেন সগিরা। সগিরা সেদিন বলেছিলেন ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি এখানে কেন?’

এই কথা বলার পর মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে সগিরাকে গুলি করেন। গুলি সগিরার হাতে লাগে। এরপর সগিরাকে আরও একটি গুলি করেন। যা সগিরার বুকের বাঁ পাশে লাগে। এ সময় সগিরা রিকশা থেকে মাটিতে পড়ে যান। তখন মারুফ রেজা আরও দুটি ফাঁকা গুলি করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান। পরে সগিরার স্বামী মামলা করলে সেই মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ দিতে থাকেন আসামি হাসান। তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আসামি মারুফ রেজা তাঁদের জানিয়েছেন সায়েদাবাদের তৎকালীন সন্ত্রাসী মুন্নার কাছ থেকে ভাড়ায় পিস্তল আনেন। সেই পিস্তল দিয়ে সগিরাকে খুন করেন। পরে সেই পিস্তল আবার তিনি মুন্নার কাছে দিয়ে দেন। মুন্না মারা গেছেন।

চিকিৎসক হাসান রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। আর আসামি মারুফ রেজা ফ্ল্যাট বেচাকেনার ব্যবসা করতেন। আর আনাস মাহমুদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, সগিরা মোর্শেদের তিন মেয়েই এখন উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের দুজন বিদেশে থাকেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




৩০ বছর আগের খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন, চার আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

আপডেট সময় : ১০:১৮:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

অনলাইন ডেস্ক; 

একজন রিকশাচালকের তথ্যে ত্রিশ বছর আগের ঢাকার একটি চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন প্রকৃত আসামি। যারা ইতিমধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সগিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এঁরা হলেন মারুফ রেজা, আনাস মাহমুদ, আনাসের দুলাভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন (আনাসের বোন)।

সেই রিকশাচালকের নাম ছালাম মোল্লা। বর্তমানে তাঁর বয়স ৫৬ বছর। খুনের ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৬ বছর। ছালামের সামনে ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হন।

খুনিদের চেহারা কেমন ছিল? কী কথা হয়েছিল খুনিদের সঙ্গে? কীভাবে সগিরা মোর্শেদকে খুন করা হয়? খুনের পর খুনিদের ধরার জন্য তিনি পিছু নিয়েছিলেন—এসব তথ্য ঢাকার আদালতকে চলতি সপ্তাহে বিস্তারিত জানান রিকশাচালক ছালাম মোল্লা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং খুনিদের চিহ্নিত করতে রিকশাচালক ছালাম মোল্লার সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর সামনেই সগিরা মোর্শেদকে খুন করা হয়। ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক ছালাম।\

কী ঘটেছিল সেদিন
মামলার কাগজপত্র ও পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, সগিরা মোর্শেদ ও তাঁর স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর। তাঁদের তিন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। রাজারবাগের একটা বাসায় বসবাস করতেন।

১৯৮৯ সালে এই দম্পতির মেয়ে সারাহাত সালমার বয়স ছিল আট বছর। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য রাজারবাগের বাসা থেকে সেদিন বিকেল ৫টায় রওনা হন সগিরা। রাজারবাগ মোড় থেকে চার টাকায় রিকশাচালক ছালামকে ভাড়া করেন। ছালাম মালিবাগ পেট্রল পাম্প থেকে শান্তিনগর মোড় দিয়ে ভিকারুননিসা স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সগিরা অল্প সময়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য মৌচাকের গলি দিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। সগিরার কথা অনুযায়ী, ছালাম মৌচাকের গলি পার হয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে যাচ্ছিলেন। স্কুলের অদূরে রিকশার গতিরোধ করে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের দুজন লোক ছিল। একজন ছিলেন লম্বা, তাঁর মুখ লম্বাকৃতির। গোঁফ ছিল পাতলা। আরেকজন ছিলেন খাটো, ভালো স্বাস্থ্যবান। তখন মোটরসাইকেল থেকে নেমে সগিরার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় একজন। আর বাঁ হাতের চুড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকে। তখন সগিরা মোর্শেদ ওই লোকটির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু তোমাকে চিনি।’ সগিরাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়। যা তাঁর বুকের বাম পাশে লেগে বুক ভেদ করে। গুলির শব্দ শোনার পর স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন ফাঁকা গুলি করে শান্তিনগরের দিকে পালিয়ে যায় তাঁরা। তখন রিকশাচালক ছালাম ‘হাইজেকার, হাইজেকার’ বলে চিৎকার দিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকেন। শান্তিনগরের মহিলা সমিতির অফিসের সামনে পর্যন্ত যান। কিন্তু ততক্ষণে খুনিরা পালিয়ে যান। এরপর সগিরা মোর্শেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন।

মামলার কাগজপত্র এবং পিবিআইয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলার তদন্ত ভার পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। সগিরা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মিন্টু নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারও শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ছয়জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। সাক্ষীরা তখন আদালতের কাছে মারুফ রেজা নামের এক ব্যক্তির নাম জানান। যিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে সাক্ষীরা জানান। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করার আবেদন করেন। আদালত তাতে সায় দেন। বিচারিক আদালতের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আসেন মারুফ রেজা। এরপর চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলাটি ২৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। গত ১১ জুলাই হাইকোর্ট পিবিআইকে অধিকতর তদন্ত করার নির্দেশ দেন।

কেন এই খুন
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রিকশাচালক ছালাম। তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। এরপর তাঁকে খুঁজে বের করেন। তাঁর দেওয়া তথ্য এবং সগিরার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, সগিরার খুনের ঘটনার প্রকৃত কারণ।

ঢাকার আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে পিবিআই বলেছে, সগিরা মোর্শেদের স্বামীর নাম আবদুস ছালাম চৌধুরী। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম সামছুল আলম চৌধুরী। মেজো ভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী। তিনজনই তাঁদের পরিবার নিয়ে আউটার সার্কুলার রোডে তখন বসবাস করতেন। সগিরা মোর্শেদরা থাকতেন দ্বিতীয় তলায়। চিকিৎসক হাসান তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনকে নিয়ে থাকতেন ওই বাসার তৃতীয় তলায়। শাহীন তিন তলা থেকে প্রায় সময় ময়লা-আবর্জনা ফেলতেন, যা সগিরা মোর্শেদের পেছনের রান্না ঘর ও সামনের বারান্দায় পড়ত। এ নিয়ে সগিরার সঙ্গে মাহমুদার প্রায় ঝগড়াঝাঁটি হতো। আর শাশুড়ি থাকতেন সগিরার সঙ্গে। তাঁর শাশুড়ি তাঁকে ভালোবাসতেন। এ নিয়ে চিকিৎসক হাসানের স্ত্রী মাহমুদা খুব হিংসা করতেন। ঝগড়ার সময় সগিরাকে মাহমুদা বলতেন, ‘দাঁড়া, আমার ভাই রেজওয়ান (আনাস মাহমুদ) আসুক। আমার ভাইকে দিয়ে তোকে মজা দেখাব। তোকে ঘর থেকে বের করব।’

পিবিআই বলছে, পারিবারিক তুচ্ছ কারণ হাসান আলী ও তাঁর স্ত্রী মাহমুদার মনে ইগোর জন্ম হয়। এক সময় মাহমুদা সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর স্বামী হাসানকে বলেন। হাসান তাতে রাজি হন। চিকিৎসক হাসানের রোগী ছিলেন মারুফ রেজা। যিনি তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সন্ত্রাসী ছিলেন। আর এই মারুফ ছিলেন সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের আত্মীয়। সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফের সঙ্গে কথা বলেন চিকিৎসক হাসান। ওই কাজের জন্য মারুফকে তখন ২৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন হাসান। আর হাসান তখন মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ করেন তাঁর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে। যাতে সগিরাকে সহজে দেখিয়ে দিতে পারেন। আনাস তাঁর দুলাভাই হাসানের বাসায় যাতায়াত করতেন। যে কারণে তিনি সগিরাকে চিনতেন।

পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, হাসান সেদিন তাঁর শ্যালক আনাস মাহমুদকে বেলা দুইটায় ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলেন। মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসবেন বলে জানান। হাসান তাঁর শ্যালককে মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরাকে দেখিয়ে দিতে বলেন। মারুফ রেজার মোটরসাইকেলে করে সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের গলি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডে ঢোকেন আনাস মাহমুদ। সগিরা মোর্শেদের রিকশা অনুসরণ করে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যেতে থাকেন। মারুফ মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরার রিকশা গতিরোধ করেন। সগিরার হাত ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে নেন মারুফ এবং হাতের চুড়ি ধরে টানা হিঁচড়া করেন। তখন আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলেন সগিরা। সগিরা সেদিন বলেছিলেন ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি এখানে কেন?’

এই কথা বলার পর মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে সগিরাকে গুলি করেন। গুলি সগিরার হাতে লাগে। এরপর সগিরাকে আরও একটি গুলি করেন। যা সগিরার বুকের বাঁ পাশে লাগে। এ সময় সগিরা রিকশা থেকে মাটিতে পড়ে যান। তখন মারুফ রেজা আরও দুটি ফাঁকা গুলি করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান। পরে সগিরার স্বামী মামলা করলে সেই মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ দিতে থাকেন আসামি হাসান। তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আসামি মারুফ রেজা তাঁদের জানিয়েছেন সায়েদাবাদের তৎকালীন সন্ত্রাসী মুন্নার কাছ থেকে ভাড়ায় পিস্তল আনেন। সেই পিস্তল দিয়ে সগিরাকে খুন করেন। পরে সেই পিস্তল আবার তিনি মুন্নার কাছে দিয়ে দেন। মুন্না মারা গেছেন।

চিকিৎসক হাসান রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। আর আসামি মারুফ রেজা ফ্ল্যাট বেচাকেনার ব্যবসা করতেন। আর আনাস মাহমুদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, সগিরা মোর্শেদের তিন মেয়েই এখন উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের দুজন বিদেশে থাকেন।