বিধ্বসংসী রূপ নিয়ে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: মহাবিপদ সঙ্কেত
- আপডেট সময় : ০২:২০:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৯ ৮৭ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক;
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বিধ্বসংসী রূপ নিয়ে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে; জারি করা হয়েছে মহাবিপদ সঙ্কেত।
দেড়শ কিলোমিটার ঘূর্ণিবায় নিয়ে বুলবুল শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ সুন্দরবন হয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানবে বলে ওই সময় উপকূলজুড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস।
তিনি দুপুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, “জোয়ার শুরু ৫টায়, পিক টাইম ৯টায়। এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।”
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টি ঝরছে; আবহাওয়ায় রয়েছে অনেকটা গুমোট ভাব, যা আইলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে উপকূলবাসীকে।
১০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও সুন্দরবন এলাকায় আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। সেই ঝড়ের শক্তি ছিল বুলবুলের মতোই।
বুলবুলের তাণ্ডবে সুন্দরবনের ক্ষতির শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ভারতীয় আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলছেন, “বাতাসের গতিবেগে থাকবে অনেক। তবে সুন্দরবন অনেকটাই প্রোটেক্ট করবে।”
ঝড় মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নিয়েছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ। উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার ১৮ লাখ মানুষকে সন্ধ্যার আগেই ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য বিভাগের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
মহাবিপদ সঙ্কেত জারির পর সমুদ্রবন্দরগুলোতে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; অভ্যন্তরীণ নৌপথেও চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার দুপুর ১২টায় মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১৫ কিমোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং কক্সবাজার থেকে ৪৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, “প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৮-১২ কিলোমিটার করে এগোচ্ছে বুলবুল। ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে উপকূলের কাছাকাছি আরও কাছাকাছি আসবে। এর প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ার বেগও বাড়বে। সন্ধ্যা নাগাদ খুলনা উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঝড়টি।”
আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, “অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার, যা ১৩০ কিলোমিটার থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।”
শনিবার সকালেই বাগেরহাটের মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। তবে কক্সবাজারে আগের মতোই ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সঙ্কেত বহাল রয়েছে।
উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর থাকবে ৯ নম্বর বিপদ সঙ্কেতের আওতায়।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে মোংলা, চট্টগ্রামসহ সব সমুদ্রবন্দরে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সার্বিক প্রস্তুতির তথ্য নিয়ে শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন।
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে ৩ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
সন্ধ্যার আগেই ১৮ লাখ মানুষকে ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিপ্তরের মহাপরিচালক শাহাদৎ হোসেন সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ সাত জেলাসহ যে সব জেলা দুর্যোগপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো থেকে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করে প্রস্তুতি সাজানো হয়েছে।
বলার পরও যারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না, তাদের নিতে বাধ্য করতে পুলিশ নামানো হয়েছে বলে জানান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণ তৎপরতার জন্য। পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ২০০০ প্যাকেট করে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে এবং ২২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করছে।
উপকূলীয় ১৩ জেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জেলার সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা গঠন করেছে ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম।
ঝড় এগিয়ে আসায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল শনিবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। শনিবার আরেক ঘোষণায় সোমবারের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে তা পরে জানানো হবে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের উদ্ভব
সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড় মাতমো গত অক্টোবরের শেষে ভিয়েতনাম হয়ে স্থলভাগে উঠে আসে। সেই ঘূর্ণিবায়ুর অবশিষ্টাংশই ইন্দোনেশিয়া পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে এসে আবার নিম্নচাপের রূপ নেয়।
বার বার দিক বদলে নিম্নচাপটি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে এসে বুধবার রাতে তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় বুলবুল।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত তালিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলের ঝড়ের নাম দেওয়া হয়। বুলবুল নামটি নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে।