ঢাকা ০৭:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo বুড়িচংয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইউএনও’র! Logo ইবি উপাচার্যকে ১০লাখ ঘুষ প্রস্তাব এক তরুনীর! Logo মামলায় জর্জরিত কুলাউড়ার ছাত্রদল নেতা মিতুল পালিয়ে আছেন প্রবাসে Logo ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে শাবি ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু Logo থিয়েটার কুবির ইফতার মাহফিল Logo রাজধানীর শান্তিনগর বাজার নিয়ে শত কোটি টাকার লুটপাট Logo ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের মৃত্যুতে শাবি শিক্ষক সমিতির শোক Logo ঢাবি শিক্ষক ড. জিয়া রহমানের মৃত্যুতে শাবি উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo ময়মনসিংহ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি সজীব, সম্পাদক আশিক Logo পুরান ঢাকায় জুতার কারখানার আগুন




দুদকের জালে সাবেক জ্বালানি সচিব নাজিম চৌধুরী

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৫৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৯ ৬৪ বার পড়া হয়েছে
শূন্য গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে ২৩০ কোটি ও তেল কোম্পানি থেকে লোপাট ৬১ কোটি টাকা * ভূমিহীনের চরে নাজিম উদ্দিনের অট্টালিকা

অনলাইন ডেস্ক;
জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে দুদকের জালে আটকা পড়েছে অবসরে যাওয়া জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার সিন্ডিকেট। ইতিমধ্যে নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেককে দুদক কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডাকা হয়েছে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাকেও।

এ তালিকায় শিগগির তার স্ত্রী চায়না চৌধুরী, সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, দীপু চৌধুরী, মইনুল হোসেন বিপ্লবসহ দেশের কয়েকজন প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক নেতাকে তলব করা হতে পারে বলেও দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদকের কাছে অভিযোগ আছে- অবসরে গেলেও এখন পর্যন্ত নাজিম উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে চলছে পুরো জ্বালানি বিভাগ।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি বিভাগের কয়েকজন শীর্ষকর্তার সঙ্গে মাসে দু-তিনবার গুলশানের একটি ক্লাবে বৈঠক করেন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। সেখানে জ্বালানি সেক্টরে ব্যবসা করেন এরকম বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীও প্রতিনিয়ত যোগ দেন। ওই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিএনপি-জামায়াত ঘরানার ব্যবসায়ীও রয়েছেন।

জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দেয়া, মনপুরা ঢাল চরের বিশাল ভূমি দখল করে শতকোটি টাকার সম্পদ অর্জন, স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে অনিয়ম, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগ, শট লিস্ট উপেক্ষা করে পছন্দের কোম্পানিকে স্পট এলএনজি আমদানির অনুমতি দেয়া, জেট ফুয়েল সরবরাহ পাইপলাইন প্রকল্পে অনিয়ম, লাইসেন্স ছাড়া বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে এলপিজি উৎপাদনে সুযোগ করে দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ গ্রহণসহ সরকারি প্রকল্পে ঘুষ লেনদেনে জড়িতদের সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে দুদক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দুদকের উপ-পরিচালক এসএম আকতার হামিদ ভূঁইয়াকে এ সংক্রান্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাজিমউদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, তাকে কখনও দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তবে জ্বালানি বিভাগের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি সচিব থাকাকালে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী তার স্ত্রী চায়না চৌধুরী ও বন্ধু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি তদবির ও ঘুষ বাণিজ্য করতেন। স্ত্রীর ফোন ছাড়া নাজিম উদ্দিন কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করতেন না। আর ফোন এলে ফাইলে যত ঝামেলাই থাকুক না কেন তিনি নির্বিঘ্নে সই করে দিতেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখেরটেকে জিন্নাহর বাসার নিচতলায় তদবির বাণিজ্যের জন্য অফিস খোলা হয়েছিল নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর আমলে। পছন্দের লোক ছাড়া ওই অফিসে কেউ প্রবেশ করতে পারতেন না। ওই অফিসে বসে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ, লাইসেন্স নেয়া ও জ্বালানি বিভাগের বিভিন্ন ফাইলের নিষ্পত্তি করা হতো। এ ছাড়া গুলশানের একটি ক্লাবে বসে বড় বড় ঠিকাদারির নেগোসিয়েশন হতো। সচিব থাকাকালীন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী নিজের ক্ষমতাবলে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বেশ কয়েকটি সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন।

দুদক ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে এসব সিএনজি স্টেশনের তালিকা নিয়ে গেছে। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে একটি সিন্ডিকেট এসব সিএনজি স্টেশনের সংযোগ বাগিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া একই কায়দায় সরকারের শট লিস্ট করা তালিকা উপেক্ষা করে এলএনজি আমদানির জন্য বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়া হয়। নেপথ্যে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট।

অপরদিকে নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি লাইসেন্স ছাড়া ১০-১২টি কোম্পানিকে এলপিজি বোতলজাতকরণের অনুমতি দিয়েছেন। অভিযোগ আছে- এ খাত থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। দুদকের একটি সূত্র জানায়, এসব অভিযোগ তারা খতিয়ে দেখছেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।

শূন্য গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে কোটি কোটি টাকা লুট : দুদক সূত্রে জানা গেছে, নাজিম উদ্দিন চৌধুরী জ্বালানি সচিব থাকাকালে জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দেন। এর মধ্যে ১২৯ কোটি টাকা নিয়ে গেছে সান্তোস। বাকি ১০১ কোটি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, দেশের সাগরবক্ষের ১৬ নম্বর ব্লকের মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। অথচ কথিত কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানিয়ে দেয়, সেখানে কোনো গ্যাসই নেই। কিন্তু এর আগেই তারা ১২৯ কোটি টাকা ‘লুটে’ নেয়।

সান্তোসের সঙ্গে ১৬ নম্বর ব্লকের উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) মেয়াদ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পরও ফের মেয়াদ বাড়ায় জ্বালানি বিভাগ। এরপর ২০১৬ সালে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে সান্তোস মগনামা-২-এ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে একবার পিএসসি সম্পন্ন হলে সেই পিএসসি সংশোধন করার সুযোগ নেই। কিন্তু সান্তোসের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

আর এসব বেআইনি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের তৎকালীন সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার সিন্ডিকেট। তিনি তখন পদাধিকারবলে বাপেক্সেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এখন অবসর জীবনযাপন করছেন।

এ বিষয়ে বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে সান্তোসের প্রস্তাবটি বোর্ডে তুলেছিলাম, যাতে প্রস্তাবটি পাস না হয়। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে মগনামায় গ্যাস নেই। বোর্ডের চেয়ারম্যান জ্বালানি সচিব, সেখানে অন্যদের কিছু করার নেই।

বিষয়টি নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ‘বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের অনিয়ম উদ্ঘাটন’ নামে গঠিত একটি কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনেও এসব তথ্য রয়েছে। কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সান্তোস চুক্তিতে সাবেক জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

কমিশনের সদস্য, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমও তখন বলেছিলেন, মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না- এ বিষয়ে বাপেক্স নিশ্চিত ছিল। সে কারণে বাপেক্স কূপ খননে রাজি ছিল না। কিন্তু সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে কূপ খনন করতে বাধ্য করেছেন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। আর কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানায়, সেখানে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। অভিনব কায়দায় এতগুলো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটিকে দুর্নীতি বললেও কম বলা হবে।

এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা অনেক আগের বিষয়। এ বিষয়ে এখন আর আমার কিছুই মনে পড়ছে না। তবে তিনি বলেন, সব গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস পাওয়া যাবে- এটা মনে করার কোনো যুক্তি নেই। বিদেশে ১০০টি গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে ১০টায় গ্যাস পাওয়ার রেকর্ড আছে। তাই বলে গ্যাসক্ষেত্র খোঁড়া যাবে না, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। তাছাড়া এ ধরনের একটি গ্যাসক্ষেত্রের কার্যাদেশ দিতে সরকারের সর্বোচ্চ লেভেলের অনুমোদন নিতে হয়। তাও নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যদি ঝুঁকি নিয়ে গ্যাস উত্তোলন করা না হতো তাহলে আজ দেশের সব শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যেত।

তেল কোম্পানিতে লুটপাট : দুদক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) নামে একটি তেল কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক এই সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। অভিযোগ আছে, তার খামারের নির্মাণসামগ্রী এসএওসিএলের তহবিল থেকে দেয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তার নামে বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ‘অমসৃণ চিরাই কাঠ’ সরবরাহের অনুমোদন বরাদ্দ করে। এর দাম ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা। এর তিন দিন পর চট্টগ্রাম ইপিজেডের ব্যাংক এশিয়ায় এসএওসিএলের হিসাব থেকে একই অঙ্কের একটি নগদ চেক ছাড় হয় বলে এসএওসিএল সূত্রে জানা গেছে। চেকটি ছিল কোম্পানির হিসাব বিভাগের প্রধান বেলায়েত হোসেনের নামে। বেলায়েত হোসেন দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, এসএওসিএলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ কোম্পানির হিসাব থেকে একটি চেক দিয়েছিলেন আমাকে। সেই অর্থ তুলে জমা দিয়েছি।

অভিযোগ আছে- চেয়ারম্যানের প্রশ্রয় পেয়ে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আর বেসরকারি মালিকদের এক ভাই মিলে প্রায় আট বছর নিজেদের সইয়ে চেকের মাধ্যমে কোম্পানিটির অন্তত ৬১ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। চেয়ারম্যান তা দেখেও না দেখার ভান করেন। তারা নিজেদের মালিকানায় একই ধরনের কোম্পানি গড়ে সেগুলোর ব্যাংক হিসাবে এই টাকার বড় অংশ জমা দিয়েছেন।

এসএওসিএল সূত্রে জানা যায়, ২০১১-র জুলাই থেকে ২০১২-র জুন পর্যন্ত ১৩৮টি চেকের মাধ্যমে ১৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ১৯১ টাকা নিয়েছে সিন্ডিকেট। এ টাকা ফেরত দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি তা দেননি। ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আগ্রাবাদে চারটি ব্যাংকে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে ১২১টি চেকের মাধ্যমে মোট ৪৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬ হাজার টাকা নগদ তোলা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে মেঘনা ব্যাংক, আইএফআইসি, মিডল্যান্ড ও এনসিসি ব্যাংক।

টাকা তোলার প্রতি তারিখে একই অঙ্কের অর্থ পিরামিড এক্সিম এবং গুডউইনের ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে। এই দু’ভাবে অন্তত ৬১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জানা গেছে, এ কোম্পানির টাকায় নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের অনেকে অসংখ্যবার বিদেশ সফর করেছেন। এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমি সচিব থাকাকালে ওই কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলাম। এ ধরনের কোনো অনিয়ম আমার জানা নেই।

এগুলো মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেউ আমাকে হেয় করার জন্য ঈর্ষান্বিত হয়ে এই তথ্য প্রচার করছে। আমি অনেক সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশ যেতে হবে- এটা আমার পরিবারের জন্য দুঃখজনক। আমার স্ত্রী কারও টাকায় বিদেশ সফর করেনি। আমিও চাকরিজীবনে বেশি বিদেশ সফর করিনি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, নাজিম চৌধুরীর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের কাছে এই কোম্পানি যে বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন, বিদেশে নিয়ে গেছেন সে সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ তাদের কাছে আছে। এসব অভিযোগও তারা খতিয়ে দেখছেন।

দুই গ্যাসকূপ খনন না করে ‘সকার’-এর রহস্যজনক বিদায় : জ্বালানি সচিব থাকাকালীন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। একদিকে পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, অপরদিকে ভালো মানের বিদেশি কোম্পানির সহায়তায় কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলন করা হয়নি। অখ্যাত বিদেশি কোম্পানি এনে শত শত কোটি টাকা গচ্চা দেয়া হয়েছে।

এরকম একটি কোম্পানির নাম সকার। জানা গেছে, আজারবাইজানের গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি ‘সকার’ (স্টেট অয়েল কর্পোরেশন অব আজারবাইজান) নামের এ কোম্পানিটি সম্প্রতি বাপেক্সকে দেয়া এক চিঠিতে বাকি দুটি কূপ খনন না করে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করার কথা জানিয়েছে। বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তিনটি কূপ খননের কথা ছিল সকারের। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে তারা মাত্র একটি কূপ (খাগড়াছড়ির সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র) খনন করেছে। সেখানে তারা কোনো ধরনের গ্যাসের সন্ধান পায়নি।

এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ এবং জামালপুরের মাদারগঞ্জে কূপ খননের জন্য কোম্পানিটি চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই দুটি কূপ খনন না করেই চুক্তি বাতিলের জন্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে কোম্পানিটি। চুক্তি বাতিল করার আবেদনে কারণ হিসেবে বিল পরিশোধে বিলম্বের অজুহাত দেখিয়েছে ‘সকার’।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্য বিদেশি কোম্পানি যেখানে প্রতিটি কূপের জন্য গড়ে ১৬০ কোটি (১৬ মিলিয়ন) ডলার দাম দিয়েছে সেখানে সকার দাম দিয়েছিল মাত্র ১১০ কোটি (১১ মিলিয়ন) ডলার। কিন্তু ওই দামে যখন বাপেক্স সকারের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন অভিজ্ঞ মহলের অনেকে বলেছিলেন, এ দামে কোনো বিদেশি কোম্পানির পক্ষে কূপ খনন করা সম্ভব হবে না। এতে সকারকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে।

অন্যথায় কাজ ফেলে চলে যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম কূপ খননের পর সকারকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর তারা নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেছিল চুক্তিবদ্ধ দ্বিতীয় ও তৃতীয় কূপ খনন ব্যয় যথাক্রমে ১৫০ ও ১৬০ কোটি ডলার করার। কিন্তু না পেরে দেশের গ্যাস সেক্টরকে বড় ধরনের বিপদে ফেলে কোম্পানিটি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

অথচ আরও অনেক বিদেশি কোম্পানি দেশের মাটির নিচে পড়ে থাকা গ্যাসসম্পদ উত্তোলনের প্রস্তাব দিলেও নাজিম চৌধুরীর অনীহার কারণে সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি তখন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিল্প-কলকারখানা বাঁচাতে একপর্যায়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সকার বিশ্বের অনেক বড় একটি কোম্পানি। তাছাড়া সবচেয়ে কম দামে তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।

ভূমিহীনের চরে নাজিম উদ্দিনের অট্টালিকা : মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ঢালচরের ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে প্রায় অর্ধেক জায়গা দখলের অভিযোগ উঠেছে সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ- তারা চরের বিশাল এলাকা দখল করে শতাধিক মাছের প্রজেক্টের পাশাপাশি তৈরি করেছেন একটি অট্টালিকা (রেস্ট হাউস)। এই অট্টালিকাকে স্থানীয়রা ‘সচিবের লালঘর’ বা ‘অট্টালিকা’ হিসেবে চেনেন। সচিবের লোকজন এখানে অবকাশযাপন করতে যান।

বিলাসিতা করে কেউ কেউ হেলিকপ্টারেও যান ওই চরে। সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরেও সচিবের মাছের প্রজেক্ট দেখা গেছে। গাছ কেটে মাছ চাষের জন্য এসব পুকুর খনন করা হয়েছে। নতুন করে আরও পুকুর খনন করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তিনি সেসময় গণমাধ্যমে বলেছেন, কোনো জমি দখল করে কিছু করা হয়নি। এগুলো আমাদের মালিকানাধীন জমি। সবকিছু দুদকসহ সব সংস্থা জানে। তাছাড়া সেখানে কোনো অট্টালিকা নেই। একটি টিনশেডের ঘর আছে। এ বিষয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ অভিযোগটি তাদের কাছেও আছে। এ নিয়েও তদন্ত চলছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




দুদকের জালে সাবেক জ্বালানি সচিব নাজিম চৌধুরী

আপডেট সময় : ১০:৫৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৯
শূন্য গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে ২৩০ কোটি ও তেল কোম্পানি থেকে লোপাট ৬১ কোটি টাকা * ভূমিহীনের চরে নাজিম উদ্দিনের অট্টালিকা

অনলাইন ডেস্ক;
জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে দুদকের জালে আটকা পড়েছে অবসরে যাওয়া জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার সিন্ডিকেট। ইতিমধ্যে নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেককে দুদক কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডাকা হয়েছে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাকেও।

এ তালিকায় শিগগির তার স্ত্রী চায়না চৌধুরী, সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, দীপু চৌধুরী, মইনুল হোসেন বিপ্লবসহ দেশের কয়েকজন প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক নেতাকে তলব করা হতে পারে বলেও দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদকের কাছে অভিযোগ আছে- অবসরে গেলেও এখন পর্যন্ত নাজিম উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে চলছে পুরো জ্বালানি বিভাগ।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি বিভাগের কয়েকজন শীর্ষকর্তার সঙ্গে মাসে দু-তিনবার গুলশানের একটি ক্লাবে বৈঠক করেন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। সেখানে জ্বালানি সেক্টরে ব্যবসা করেন এরকম বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীও প্রতিনিয়ত যোগ দেন। ওই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিএনপি-জামায়াত ঘরানার ব্যবসায়ীও রয়েছেন।

জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দেয়া, মনপুরা ঢাল চরের বিশাল ভূমি দখল করে শতকোটি টাকার সম্পদ অর্জন, স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে অনিয়ম, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগ, শট লিস্ট উপেক্ষা করে পছন্দের কোম্পানিকে স্পট এলএনজি আমদানির অনুমতি দেয়া, জেট ফুয়েল সরবরাহ পাইপলাইন প্রকল্পে অনিয়ম, লাইসেন্স ছাড়া বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে এলপিজি উৎপাদনে সুযোগ করে দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ গ্রহণসহ সরকারি প্রকল্পে ঘুষ লেনদেনে জড়িতদের সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে দুদক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দুদকের উপ-পরিচালক এসএম আকতার হামিদ ভূঁইয়াকে এ সংক্রান্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাজিমউদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, তাকে কখনও দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তবে জ্বালানি বিভাগের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি সচিব থাকাকালে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী তার স্ত্রী চায়না চৌধুরী ও বন্ধু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি তদবির ও ঘুষ বাণিজ্য করতেন। স্ত্রীর ফোন ছাড়া নাজিম উদ্দিন কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করতেন না। আর ফোন এলে ফাইলে যত ঝামেলাই থাকুক না কেন তিনি নির্বিঘ্নে সই করে দিতেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখেরটেকে জিন্নাহর বাসার নিচতলায় তদবির বাণিজ্যের জন্য অফিস খোলা হয়েছিল নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর আমলে। পছন্দের লোক ছাড়া ওই অফিসে কেউ প্রবেশ করতে পারতেন না। ওই অফিসে বসে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ, লাইসেন্স নেয়া ও জ্বালানি বিভাগের বিভিন্ন ফাইলের নিষ্পত্তি করা হতো। এ ছাড়া গুলশানের একটি ক্লাবে বসে বড় বড় ঠিকাদারির নেগোসিয়েশন হতো। সচিব থাকাকালীন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী নিজের ক্ষমতাবলে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বেশ কয়েকটি সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন।

দুদক ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে এসব সিএনজি স্টেশনের তালিকা নিয়ে গেছে। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে একটি সিন্ডিকেট এসব সিএনজি স্টেশনের সংযোগ বাগিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া একই কায়দায় সরকারের শট লিস্ট করা তালিকা উপেক্ষা করে এলএনজি আমদানির জন্য বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়া হয়। নেপথ্যে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট।

অপরদিকে নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি লাইসেন্স ছাড়া ১০-১২টি কোম্পানিকে এলপিজি বোতলজাতকরণের অনুমতি দিয়েছেন। অভিযোগ আছে- এ খাত থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। দুদকের একটি সূত্র জানায়, এসব অভিযোগ তারা খতিয়ে দেখছেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।

শূন্য গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে কোটি কোটি টাকা লুট : দুদক সূত্রে জানা গেছে, নাজিম উদ্দিন চৌধুরী জ্বালানি সচিব থাকাকালে জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দেন। এর মধ্যে ১২৯ কোটি টাকা নিয়ে গেছে সান্তোস। বাকি ১০১ কোটি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, দেশের সাগরবক্ষের ১৬ নম্বর ব্লকের মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। অথচ কথিত কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানিয়ে দেয়, সেখানে কোনো গ্যাসই নেই। কিন্তু এর আগেই তারা ১২৯ কোটি টাকা ‘লুটে’ নেয়।

সান্তোসের সঙ্গে ১৬ নম্বর ব্লকের উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) মেয়াদ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পরও ফের মেয়াদ বাড়ায় জ্বালানি বিভাগ। এরপর ২০১৬ সালে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে সান্তোস মগনামা-২-এ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে একবার পিএসসি সম্পন্ন হলে সেই পিএসসি সংশোধন করার সুযোগ নেই। কিন্তু সান্তোসের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

আর এসব বেআইনি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের তৎকালীন সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার সিন্ডিকেট। তিনি তখন পদাধিকারবলে বাপেক্সেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এখন অবসর জীবনযাপন করছেন।

এ বিষয়ে বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে সান্তোসের প্রস্তাবটি বোর্ডে তুলেছিলাম, যাতে প্রস্তাবটি পাস না হয়। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে মগনামায় গ্যাস নেই। বোর্ডের চেয়ারম্যান জ্বালানি সচিব, সেখানে অন্যদের কিছু করার নেই।

বিষয়টি নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ‘বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের অনিয়ম উদ্ঘাটন’ নামে গঠিত একটি কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনেও এসব তথ্য রয়েছে। কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সান্তোস চুক্তিতে সাবেক জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

কমিশনের সদস্য, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমও তখন বলেছিলেন, মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না- এ বিষয়ে বাপেক্স নিশ্চিত ছিল। সে কারণে বাপেক্স কূপ খননে রাজি ছিল না। কিন্তু সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে কূপ খনন করতে বাধ্য করেছেন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। আর কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানায়, সেখানে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। অভিনব কায়দায় এতগুলো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটিকে দুর্নীতি বললেও কম বলা হবে।

এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা অনেক আগের বিষয়। এ বিষয়ে এখন আর আমার কিছুই মনে পড়ছে না। তবে তিনি বলেন, সব গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস পাওয়া যাবে- এটা মনে করার কোনো যুক্তি নেই। বিদেশে ১০০টি গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে ১০টায় গ্যাস পাওয়ার রেকর্ড আছে। তাই বলে গ্যাসক্ষেত্র খোঁড়া যাবে না, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। তাছাড়া এ ধরনের একটি গ্যাসক্ষেত্রের কার্যাদেশ দিতে সরকারের সর্বোচ্চ লেভেলের অনুমোদন নিতে হয়। তাও নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যদি ঝুঁকি নিয়ে গ্যাস উত্তোলন করা না হতো তাহলে আজ দেশের সব শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যেত।

তেল কোম্পানিতে লুটপাট : দুদক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) নামে একটি তেল কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক এই সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। অভিযোগ আছে, তার খামারের নির্মাণসামগ্রী এসএওসিএলের তহবিল থেকে দেয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তার নামে বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ‘অমসৃণ চিরাই কাঠ’ সরবরাহের অনুমোদন বরাদ্দ করে। এর দাম ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা। এর তিন দিন পর চট্টগ্রাম ইপিজেডের ব্যাংক এশিয়ায় এসএওসিএলের হিসাব থেকে একই অঙ্কের একটি নগদ চেক ছাড় হয় বলে এসএওসিএল সূত্রে জানা গেছে। চেকটি ছিল কোম্পানির হিসাব বিভাগের প্রধান বেলায়েত হোসেনের নামে। বেলায়েত হোসেন দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, এসএওসিএলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ কোম্পানির হিসাব থেকে একটি চেক দিয়েছিলেন আমাকে। সেই অর্থ তুলে জমা দিয়েছি।

অভিযোগ আছে- চেয়ারম্যানের প্রশ্রয় পেয়ে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আর বেসরকারি মালিকদের এক ভাই মিলে প্রায় আট বছর নিজেদের সইয়ে চেকের মাধ্যমে কোম্পানিটির অন্তত ৬১ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। চেয়ারম্যান তা দেখেও না দেখার ভান করেন। তারা নিজেদের মালিকানায় একই ধরনের কোম্পানি গড়ে সেগুলোর ব্যাংক হিসাবে এই টাকার বড় অংশ জমা দিয়েছেন।

এসএওসিএল সূত্রে জানা যায়, ২০১১-র জুলাই থেকে ২০১২-র জুন পর্যন্ত ১৩৮টি চেকের মাধ্যমে ১৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ১৯১ টাকা নিয়েছে সিন্ডিকেট। এ টাকা ফেরত দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি তা দেননি। ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আগ্রাবাদে চারটি ব্যাংকে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে ১২১টি চেকের মাধ্যমে মোট ৪৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬ হাজার টাকা নগদ তোলা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে মেঘনা ব্যাংক, আইএফআইসি, মিডল্যান্ড ও এনসিসি ব্যাংক।

টাকা তোলার প্রতি তারিখে একই অঙ্কের অর্থ পিরামিড এক্সিম এবং গুডউইনের ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে। এই দু’ভাবে অন্তত ৬১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জানা গেছে, এ কোম্পানির টাকায় নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের অনেকে অসংখ্যবার বিদেশ সফর করেছেন। এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমি সচিব থাকাকালে ওই কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলাম। এ ধরনের কোনো অনিয়ম আমার জানা নেই।

এগুলো মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেউ আমাকে হেয় করার জন্য ঈর্ষান্বিত হয়ে এই তথ্য প্রচার করছে। আমি অনেক সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশ যেতে হবে- এটা আমার পরিবারের জন্য দুঃখজনক। আমার স্ত্রী কারও টাকায় বিদেশ সফর করেনি। আমিও চাকরিজীবনে বেশি বিদেশ সফর করিনি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, নাজিম চৌধুরীর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের কাছে এই কোম্পানি যে বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন, বিদেশে নিয়ে গেছেন সে সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ তাদের কাছে আছে। এসব অভিযোগও তারা খতিয়ে দেখছেন।

দুই গ্যাসকূপ খনন না করে ‘সকার’-এর রহস্যজনক বিদায় : জ্বালানি সচিব থাকাকালীন নাজিম উদ্দিন চৌধুরী দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। একদিকে পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির (বাপেক্স) সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, অপরদিকে ভালো মানের বিদেশি কোম্পানির সহায়তায় কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলন করা হয়নি। অখ্যাত বিদেশি কোম্পানি এনে শত শত কোটি টাকা গচ্চা দেয়া হয়েছে।

এরকম একটি কোম্পানির নাম সকার। জানা গেছে, আজারবাইজানের গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি ‘সকার’ (স্টেট অয়েল কর্পোরেশন অব আজারবাইজান) নামের এ কোম্পানিটি সম্প্রতি বাপেক্সকে দেয়া এক চিঠিতে বাকি দুটি কূপ খনন না করে তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করার কথা জানিয়েছে। বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তিনটি কূপ খননের কথা ছিল সকারের। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে তারা মাত্র একটি কূপ (খাগড়াছড়ির সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র) খনন করেছে। সেখানে তারা কোনো ধরনের গ্যাসের সন্ধান পায়নি।

এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ এবং জামালপুরের মাদারগঞ্জে কূপ খননের জন্য কোম্পানিটি চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই দুটি কূপ খনন না করেই চুক্তি বাতিলের জন্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে কোম্পানিটি। চুক্তি বাতিল করার আবেদনে কারণ হিসেবে বিল পরিশোধে বিলম্বের অজুহাত দেখিয়েছে ‘সকার’।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্য বিদেশি কোম্পানি যেখানে প্রতিটি কূপের জন্য গড়ে ১৬০ কোটি (১৬ মিলিয়ন) ডলার দাম দিয়েছে সেখানে সকার দাম দিয়েছিল মাত্র ১১০ কোটি (১১ মিলিয়ন) ডলার। কিন্তু ওই দামে যখন বাপেক্স সকারের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন অভিজ্ঞ মহলের অনেকে বলেছিলেন, এ দামে কোনো বিদেশি কোম্পানির পক্ষে কূপ খনন করা সম্ভব হবে না। এতে সকারকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে।

অন্যথায় কাজ ফেলে চলে যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম কূপ খননের পর সকারকে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। এরপর তারা নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেছিল চুক্তিবদ্ধ দ্বিতীয় ও তৃতীয় কূপ খনন ব্যয় যথাক্রমে ১৫০ ও ১৬০ কোটি ডলার করার। কিন্তু না পেরে দেশের গ্যাস সেক্টরকে বড় ধরনের বিপদে ফেলে কোম্পানিটি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

অথচ আরও অনেক বিদেশি কোম্পানি দেশের মাটির নিচে পড়ে থাকা গ্যাসসম্পদ উত্তোলনের প্রস্তাব দিলেও নাজিম চৌধুরীর অনীহার কারণে সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি তখন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিল্প-কলকারখানা বাঁচাতে একপর্যায়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সকার বিশ্বের অনেক বড় একটি কোম্পানি। তাছাড়া সবচেয়ে কম দামে তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।

ভূমিহীনের চরে নাজিম উদ্দিনের অট্টালিকা : মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ঢালচরের ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে প্রায় অর্ধেক জায়গা দখলের অভিযোগ উঠেছে সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ- তারা চরের বিশাল এলাকা দখল করে শতাধিক মাছের প্রজেক্টের পাশাপাশি তৈরি করেছেন একটি অট্টালিকা (রেস্ট হাউস)। এই অট্টালিকাকে স্থানীয়রা ‘সচিবের লালঘর’ বা ‘অট্টালিকা’ হিসেবে চেনেন। সচিবের লোকজন এখানে অবকাশযাপন করতে যান।

বিলাসিতা করে কেউ কেউ হেলিকপ্টারেও যান ওই চরে। সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরেও সচিবের মাছের প্রজেক্ট দেখা গেছে। গাছ কেটে মাছ চাষের জন্য এসব পুকুর খনন করা হয়েছে। নতুন করে আরও পুকুর খনন করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তিনি সেসময় গণমাধ্যমে বলেছেন, কোনো জমি দখল করে কিছু করা হয়নি। এগুলো আমাদের মালিকানাধীন জমি। সবকিছু দুদকসহ সব সংস্থা জানে। তাছাড়া সেখানে কোনো অট্টালিকা নেই। একটি টিনশেডের ঘর আছে। এ বিষয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ অভিযোগটি তাদের কাছেও আছে। এ নিয়েও তদন্ত চলছে।