সকালের সংবাদ ডেস্ক ॥ দেশব্যাপী নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। যা প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে সরকার এবং বিচার বিভাগ। কিন্তু সেই মুহুর্তে সালিশ মিমাংসার নামে ধামা চাপা দেয়া হয়েছে কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা। থানা পুলিশ এবং স্থানীয় মেম্বাররা মিলে মাত্র ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছে দুই সন্তানের জনক কর্তৃক ধর্ষিত অসহায় কিশোরীর ইজ্জত।
ঘটনাটি প্রায় এক মাস পূর্বে বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বুসারের পিঠ নামক গ্রামের জনবিচ্ছিন্ন এক চরে ঘটেছে। যা নিয়ে গোটা এলাকা জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছে না এলাকার অসহায় মানুষগুলো। কেননা ধর্ষণের ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার পেছনে খোদ থানার ওসি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী সাবেক ও বর্তমান তিন মেম্বারের সম্পৃক্ততার কারণে মুখ বুজে আছে গ্রামবাসি। তাছাড়া সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করা এক যুবককে বেধড়ক মারধরের ঘটনা ঘটে।
কিন্তু মেয়ে এবং তার পরিবারের অভিযোগ ও প্রকাশ্যে এতসব ঘটার পরেও কিছুই জানেন না বলে দাবী করেছেন অভিযুক্ত বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান। তার দাবী মেম্বাররা নিজেরা বাঁচতে পুলিশকে জড়াচ্ছে। আর অভিযুক্ত মেম্বাররা বলছেন যা কিছুই হয়েছে তার সব কিছু পুলিশের উপস্থিতিতেই হয়েছে। তাছাড়া বক্তব্য নেয়ার পর পরই নিউজ বন্ধ করতে ওসি মিজানুর রহমান বিভিন্নভাবে তদবির শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে দেন অনৈতিক প্রস্তাব।
ধর্ষিতা ১৩ বছরের কিশোরী জানায়, ‘গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যে কোন বুধবার দুপুর দুইটার দিকের ঘটনা। কলস নিয়ে পানি আনতে ঘর থেকে বের হন কিশোরী। পথিমধ্যে ধান খেতে হালচাষে ব্যস্ত থাকা মুলাদী উপজেলার কাজীরচর এলাকার বাসিন্দা মৃত আর্শেদ হাওলাদারের ছেলে দুই সন্তানের জনক দুলাল হাওলাদার পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে তার পথরোধ করে।
কিশোরী অভিযোগ করে বলেন, ‘দুলাল পথরোধ করে পাশ্ববর্তী পাট খেতে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাত ধরে টানা হেচড়া করে। যেতে না চাইলে জোর করে কোলে তুলে পাঠ খেতের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ধর্ষণ করে। তখন কিশোরী চিৎকার দিলে পাশ্ববর্তী দুই যুবক ঘটনাস্থলে পৌছে তাকে উদ্ধার করে।
এদিকে ঘটনাটি জানাজানির পরেই শুরু হয় ধামা চাপা দেয়ার প্রক্রিয়া। তবে মেয়ের অসহায় পরিবার এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। এমনকি বিচারের দাবি নিয়ে মেয়ের মা ওই দিন মেয়েকে নিয়ে বাবুগঞ্জ থানায়ও যান। সেখানে হাজির হন বাবুগঞ্জের রহমতপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বিএনপি নেতা জামাল হোসেন পুতুল, মুলাদীর কাজীরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বর সেলিম হাওলাদার, তার মেয়ে জামাই বর্তমান মেম্বর ও আওয়ামী লীগ নেতা শামীম খান, মেয়ের চাচাত ভাই সেলিম হাওলাদার, স্থানীয় হারুন মাল ও নাসিরসহ বেশ কয়েকজন।
মেয়ের মা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা মামলা করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করেনি। বরং আমাদের বিভিন্নভাবে ভয় ভিতি প্রদর্শন করে। ‘মামলা করলে কে চালাবে ? মামলা করলে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতাকেও জেলে যেতে হবে’ এ ধরনের অসংলগ্ন কথা বলেন ওসি এবং মেম্বাররা। তাদের এসব কথা শুনে আমরা ভিতু হয়ে পড়ি।
এক পর্যায় বাবুগঞ্জ থানার ওসি ঘটনাটি ক্ষতিপূরনের মাধ্যমে মিমাংসা করে দিতে মেম্বার সহ স্থানীয়দের নির্দেশ দেন। এমনকি ক্ষতিপূরন বাবদ মেয়েকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করে দেয়ার জন্যও মেম্বারদের নির্দেশনা দেন ওসি। কিন্তু ওসি’র বলে দেয়া ৫০ হাজার টাকা আমরা পাইনি। ঘটনাটি প্রকাশ না করার জন্য ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরন দিয়েছে। এমনকি তা ইসলামী ব্যাংক রহমতপুর শাখায় মেয়ের নামে একটি এফডিআর করে জমা দেয়া হয়েছে।
মেয়ের বাবা-মা বলেন, ‘যে টাকা দিছে তা আমরা আমাদের হাত দিয়েও ধরিনি। যা করার মেম্বার এবং উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিরাই করেছে। কিন্তু আমরা এই ক্ষতিপুরন চাইনি। আমরা চেয়েছি বিচার। এমনকি ক্ষতিপূরণ নয় বরং এই ঘটনায় আইনি বিচার দাবি করেছেন ধর্ষিতা কিশোরী।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ধর্ষক দুলাল হাওলাদার মুলাদীর কাজীরচর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আব্দুল মালেক এর ভায়রা। সেই সুবাদে আব্দুল মালেকের মেয়ে জামাই বর্তমান মেম্বার শামীম খানও ধর্ষকের আত্বীয়। তারা দু’জন বাবুগঞ্জের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জামাল হোসেন পুতুলকে সাথে নিয়ে অর্থের বিনিময়ে ঘটনা ধামা চাপা দেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বাবুগঞ্জ উপজেলার ইউপি সদস্য জামাল হোসেন পুতুল বলেন, ‘ঘটনাটি মাত্র ১০ হাজার টাকায় মিমাংসার চেষ্টা চলছিলো। কিন্তু আমি জানার পরে ক্ষতিপুরনের পরিমান ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছি। এমনকি ওই টাকা মেয়ের নামে ৩ বছরের একটি এফডিআর করে ব্যাংকে জমা দিয়েছি। এফডিআর’র জন্য যে টাকা খরচ হয়েছে তাও আমার নিজের পকেট থেকে দিয়েছি।
ধর্ষণ সালিশ যোগ্য অপরাধ নয় এমনটি স্বীকার করে পুতুল মেম্বার বলেন, ‘সালিশের বিষয়টি থানায় বসেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওসি সাহেব সব নিজেই বলেছেন এটি সামাধান করে দিতে। কিন্তু তিনি যে ক্ষতিপুরনের কথা বলেছেন সেটা আদায় করে দেয়া সম্ভব হতো না। কারন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে নিজেও গরিব। তাছাড়া মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে আমি ধর্ষণের ঘটনার সালিশ করেছি। এটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আপনারা পারলে আমায় ধরেন।
এদিকে ধর্ষক দুলালের ভায়রা সাবেক মেম্বার আব্দুল খালেক বলেন, ‘ওই ঘটনার কোন সালিশ হয়নি। এটি কোন ধর্ষণের ঘটনা না। দুলাল ধান খেতে চাষ করতে ছিলো। দুই ব্যক্তি তাকে ধান খেত থেকে ডেকে এনে মেয়ের পাশে দাড় করিয়ে ছবি তুলে মিথ্যা অপবাদ দেয়। এ খবর পেয়েই আমি সেখানে যাই।
তিনি বলেন, আমি কোন অপরাধের পক্ষে নই। আমি ন্যায়ের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছি সব সময়। তবে ধর্ষণের ঘটনাটি কেন টাকার বিনিময়ে ধামা চাপা দেয়া হলো এমন প্রশ্ন করা হলে কোন উত্তর না দিয়ে ব্যস্ততার কথা বলে পড়ে ফোন করবেন বলে এড়িয়ে যান সাবেক মেম্বার আব্দুল মালেক।
অপরদিকে অভিযোগের বিষয়ে বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি এই থানায় নতুন এসেছি। এলাকা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সবকিছু জানতেও পারিনি। তাছাড়া যে ধর্ষণের ঘটনার নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে সে ধরনের কোন অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে কেউ আসেনি। আর আসলে অবশ্যই আমি মামলা নিতাম। কেননা ধর্ষণ বড় অপরাধ। এখানে সালিশ মিমাংসার কোন সুযোগ নেই।
মেম্বার পুতুলের দেয়া বক্তব্যের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে ওসি বলেন, ‘হতে পারে মেম্বাররাই সালিশ করে ধামা চাপা দিয়েছে। এখন নিজেরা বাঁচতে পুলিশের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। কেননা আমি এই ঘটনা আদৌ শুনিনি। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে জানিয়েছেন ওসি।
বাবুগঞ্জ থানা সূত্রে জানাগেছে, ‘বর্তমান অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান বাবুগঞ্জ থানায় যোগদান করেছেন গত ২ সেপ্টেম্বর। আর ওই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তিনি যোগদানের কয়েক দিনের মাথায় ১৫ থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। তাই ঘটনাটি অস্বীকার করার পেছনে ওসি’র ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার বিষয়ে সংবাদ মাধ্যম ওসি’র বক্তব্য নেয়ার পর পরই নিউজ থামাতে শুরু হয় লবিং-তদবির। বাবুগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক সহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিউজ না করার জন্য অনৈতিক প্রস্তাব দেয়ান ওসি মিজানুর রহমান।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এমন কোন ঘটনা আমার জানা নেই। তাছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই তার বিচার হবে। পুরো বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।