মাদক সম্রাট মনু মিয়া থেকে মনু চেয়ারম্যান ধরাছোঁয়ার বাইরে!
- আপডেট সময় : ০৭:৩৬:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০১৯ ১৩৬ বার পড়া হয়েছে
মোঃ আবু সাইদ মিঞা ওরফে মনু মিয়া পিরোজপুরের কাউখালী এলাকায় মনু চেয়ারম্যান হিসেবে এবং ঢাকায় একজন ব্যবসায়ী/ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। তবে অপরাধ জগতে তার নাম মাদক সম্রাট মনু মিয়া। মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর তার বেশভুষায় চলে আসে আমুল পরিবর্তন। মনু মিয়ার সাম্প্রতিক সুন্নতি লেবাস দেখে পূর্বপরিচিত অনেকেরও হয়তো তাকে চিনতে কিছুটা কষ্ট হবে। এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জেপি)র প্রার্থী হয়েছেন তিনি। গনসংযোগে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
মাদক সম্রাট যখন জনপ্রতিনিধি
পূর্বদিকে সন্ধ্যা আর পশ্চিমে কালীগঙ্গা নদী। মাঝখানে ১৪ বর্গকিলোমিটারের জনপদ সয়না রঘুনাথপুর। বছরের পর বছর ধরে দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না এ ইউনিয়নবাসীর। এই সুযোগে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে মনু তেমন কোনো বাধা ছাড়াই সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্থানীয় সরকারকে জিম্মি রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট, নির্বাচিত পরিষদ, দাপ্তরিক কর্মচারী, ডিজিটাল সেন্টারের সরঞ্জাম ইত্যাদি সকল সুবিধা দেয়া হলেও স্থায়ী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ নেন নি। এলাকাবাসীকে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন, তিনি তার ব্যক্তিগত অর্থেই সবকিছু চালিয়ে রাখছেন। এবার কাউখালী উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সংসদ নির্বাচনকে উপলক্ষ করে। রাজনীতিতে স্থান পেতে বড় অংকের টাকা ঢালতে কার্পণ্য করছেন না। তার রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার তথা জনপ্রতিনিধি হওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য নিরাপদে মাদক ব্যবসা করা। কাউখালীর বেশিরভাগ এলাকাবাসী হয়তো জানেনই না যে তাদের মনু চেয়ারম্যান একজন মাদক সম্রাট।
মাদক ব্যবসা পরিচালনার কৌশল
কাউখালীর গোয়ালতা গ্রামের সালেক মিঞা ও পারুল বেগমের পুত্র মনু এসএসসি পাশ করার পর জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। গৌরনদীর মাদক ব্যবসায়ী মানিক মাঝির সঙ্গে বন্ধুত্ব জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মনু জড়িয়ে পড়েন অপরাধ জগতে। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করেন ইয়াবা ব্যবসা। দুই বছরের মধ্যে বৃহত্তর বরিশালের মাদক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক বনে যান কাউখালীর মনু মিয়া, গৌড়নদীর মানিক মাঝি ও মাদক সম্রাট খ্যাত ঝালকাঠির জাহিদ। মাদক ব্যবসা পরিচালনার কৌশল পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার পারসাতুরিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ময়নুদ্দিনের ছেলে মোঃ সাইফুল ইসলামের (২৭) পেশা মুদি ব্যবসা। মনু মিয়ার বদৌলতে উচ্চ লাভের আশায় মুদির দোকানের আড়ালে দীর্ঘদিন যাবৎ মাদক ব্যবসা চালিয়েছিলেন। কাউখালী সদর ইউনিয়নের গান্ডতা গ্রামের মানিক সেনের ছেলে মনোজ সেন (২২), সোনাপুর গ্রামের চুন্নু শেখ (৩৫), এমন প্রায় দুই শতাধিক খুচরা মাদক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে চলে মনুর মাদক সিন্ডিকেট।
ইয়াবা শুধু নয়:
ইয়াবা মূল ব্যবসা হলেও চাহিদা অনুসারে মদ, ফেন্সিডিল ও গাজার ব্যবসাও চলে একই সাথে। মাঠ পর্যায়ের পুঁজিবিহীন খুচরা মাদক বিক্রেতা ছাড়াও নগদ অর্থে মাদক ক্রয় করলে পাইকারি দরে দেয়া হয়। কাউখালীর চরবাশুরী গ্রামের নুরুল ইসলাম খান বা সেলিম খানের মত স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও মনুর নেটওয়ার্কের অন্তর্গত। উল্লেখ্য, নুরুল ইসলাম গত নির্বাচনে মনুর প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিএনপির দলীয় প্রার্থী ছিল। রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধ থাকলেও ব্যবসায়িক সম্পর্ক সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
মিডিয়ায় মনু মিয়ার অপকর্মের তথ্য:
মাদক সম্রাট হিসেবে পরিচিত মনুর নামে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় জনপ্রতিনিধিদের মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়ে ‘জনপ্রতিনিধিরাই ইয়াবা কারবারি’ নামের একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বরিশাল কেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেটের শীর্ষ নেতা হিসেবে আবু সাঈদ মনু মিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়। ‘রাইজিং বিডি’ নামক পত্রিকার টেকনাফ স্থানীয় প্রতিনিধির বরাত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার উপর ভিত্তি করে একটি সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৬ জুন। সেই প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা ক্রেতাদের মধ্যে আবু সাঈদ মনুকে ফকিরাপুলের ইয়াবা সম্রাট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মনুদের মত গডফাদারদের হাত ধরে সারাদেশের অনেকেই ভয়ঙ্কর ইয়াবা ব্যবসায় নাম লিখাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় মনু
টেকনাফ হচ্ছে মনুর অন্যতম অভয়াশ্রম। দেশের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাহেদুর রহমান নিপু এবং মোঃ ফয়সালের বিশ্বস্ত ক্রেতাদের অন্যতম একজন মনু। ঢাকায় আবু সাঈদ মনুর সহযোগী মোহাম্মদপুর এলাকার মাদক সম্রাজ্ঞী আসমা আহমেদ ডালিয়া। ডালিয়ার পুরো পরিবার মাদক ব্যবসায় জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ৩৭ জনের তালিকায় ডালিয়া সহ মনুর নাম এসেছে সাত নম্বরে।
জাল টাকার ব্যবসাঃ
মনুর নাম মাদক ছাড়াও জাল টাকার ব্যবসার জন্য বহুল আলোচিত। মনুর বিশ্বস্ত কর্মচারিদের মধ্যে রফিক, জাকির, হানিফ, রাজন ও শিকদারের নেতৃত্বে একটি চক্র জাল টাকার ব্যবসা করে। এলাকা ছাড়াও মাদক ক্রয় বিক্রয়ের সময় জাল টাকা চালিয়ে দেয়া সহজ হয় বলে এই ব্যবসায়ও ঝুঁকে পড়ে মনু। মনুর বিরুদ্ধে জাল টাকা সংশ্লিষ্ট একটি মামলার তদন্ত চলমান।
মাদক ও জাল টাকার ব্যবসার মাধ্যমে ফুলেফেঁপে ওঠা আবু সাইদ মনু মিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর এলাকার অগ্রগতি হয়নি সামান্যতম। সনদপত্র বা জন্মনিবন্ধন পেতে হেঁটে ছুটতে হয় ইউনিয়নের বেতকা বা সোনাকুর থেকে মেঘপাল গ্রাম পর্যন্ত। ১০-১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। নদীভাঙন ইউনিয়নটির মানচিত্র বদলে দিচ্ছে। সন্ধ্যা ও কালীগঙ্গা নদীর অব্যাহত ভাঙনে প্রায় একযুগে তিন শতাধিক একর ফসলি জমি, পাঁচ শতাধিক বসতঘর, বহু সড়ক, পুল-কালভার্ট চলে গেছে নদীতে। হোগলা-কাঁঠালিয়া থেকে শির্ষা গ্রামের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে। কালীগঙ্গার ভাঙনে বেতকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একাধিক মসজিদ ও বেতকা ব্রিজ বিলীনের পথে। সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনটি ১৯৮০ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা হয়। মনুর এ উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয় উপেক্ষা করার কারণ মাদক ব্যবসা বলেই ধারণা করা হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচিত হলে গোটা উপজেলাকেই মাদক ও জাল টাকার সিন্ডিকেটে নিয়ে আসা হবে এমন আশঙ্কা অনেকের। মাদক বিরোধী যে অভিযান চলছে তাতে মনুর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর তদন্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি সকলের।