১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের তথা বাঙ্গালী জাতির বিজয় দিবস। এদিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরনিয় দিন। এদিনটি বাঙ্গালীর জীবনে একদিনের সংগ্রামে আসেনি। এর পিছনে ব্যায় করতে হয়েছে বাঙ্গালীর বুকের তাঁজা এক সাগর রক্ত। হারাতে হয়েছে অসংখ্য মা-বোনের মূল্যবান সম্পদ তাদের ইজ্জতকে । দেখতে হয়েছে প্রতিমূহুর্তে তাদের খোকার র তরু তাঁজা লাশ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর বিমাতা সূলভ আচরণ করতে থাকে।
সেই অত্যাচারিরা প্রথমে যে জিনিসের উপর আঘাত হানে তা হলো বাঙ্গালী জাতি তথা জাতিসত্বার প্রাণের ভাষা, যে ভাষায় তারা কথা বলে সে মাতৃভাষার উপর আঘাত হানে। বাঙ্গালী জাতির মাতৃভাষাকে তারা পদদলিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। যার প্রতিবাদে শুরু হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। তারা আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায়নি।
কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এদেশের জনগনকে পিছিয়ে রাখে। যার কারণেই ৬৯ গণঅভ্যুত্থান,৭০ এর নির্বাচন,৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। মুক্তিকামী বাঙ্গালীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রক্তপিপাসু, হিং¯্র পাকিস্থানি লম্পটদের সেনাবাহিনি যখন ঢাকার পিলকানা ই,পি,আর হেড কোয়ার্টার , রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমন চালিয়ে কালো রাত্রির সূচনা করে। বাঙ্গালীর দামাল ছেলেরা তখন ঘরে বসে না থেকে এর প্রতিবাদে তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলন মূখর হয়ে উঠে। আর তখন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রত্যেক বিপ্লবের পিছনে একজন বিপ্লবী নেতার প্রয়োজন।
আর একথা অবশ্যই বলতে হবে স্বাধীনতা মহান যুদ্ধের সেই বিপ্লবী নেতাটি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই পাকিস্থানি চক্র সেটা বুঝতে পেরেই স্বাধীনতা বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ,মুক্তিযুদ্ধেও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিটিকে ২৬ শে মার্চ পাকিস্থানি হানাদার বাহিনি প্রথম প্রহরে বন্দি করে। আর বন্দি হবার পূর্বাবাস লক্ষ্য করে বন্দি হবার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিডিআর বর্তমান বিজিবি তৎকালীন ইপিআর এর বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন।
আর সেই ঘোষণার সোপাতেই কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, আপামর জনতা সকলেই ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তি যুদ্ধে। দেশকে হিং¯্রদের হাত থেকে অন্যায় অত্যাচর নিপীরন থেকে রক্ষা করবার জন্য মুক্তির মানসে জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে ছাত্র, যুবক, প্রভৃতি সম্প্রদায় হতে যুদ্ধে গমন ইচ্ছুক লোকদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনি। তারা স্বল্প প্রশিক্ষন নিয়ে দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে অস্ত্র হাতে দেশের বন জঙ্গলে গ্রামে-গঞ্জে ঢুকে পড়ে। আর দেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। আর তা না হলে কোন ভাবেই সম্ভব হতো না এদেশকে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করা।
যেখানে পাকিস্থানি জল্লাদ বাহিনি মাত্র ৩ দিনে বাংলাদেশকে বাঙ্গালী নিয়ন্ত্রন মুক্ত করবে বলে প্রদক্ষেপ হাতে নিয়েছিল।কিন্তু হানাদার বাহিনি এটা বুঝতে পারেনি বাংলার মাটি যে দুর্জয় ঘাটি। তা তখন বাঙ্গালীরা শ্রীগ্রই প্রমান করে দেখিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময় নিরস্ত্র বাঙ্গালীগণ সুশিক্ষিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির হিং¯্রতা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য মুক্তির দুর্জয় শপথ নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলো। বাঙ্গালী ছাত্র ও যুবকেরা শত্রুকে আঘাত হানবার প্রয়োজনীয় রণ কৌশল শিখে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।
আর তা শিখে ইতিমধ্যেই দ্রুতগতিতে বাংলার বন জঙ্গলে গ্রামে-গঞ্জে এবং শহর বন্দরে ঢুকে পড়ে। মা-বোনের ইজ্জতের বদলা এবং নিরিহ জনগণের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহনে মৃত্যুর দৃঢ় শপথ নিয়ে তারা হানাদার বাহিনীর উপর বিভিন্ন ভাবে তাদের জীবনকে বাজি রেখে আঘাত হানতে শুরু করে। তারা বাংলার রাস্তা-ঘাট, সেতু কালভার্ট ধ্বংস করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনিকে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। আর মুক্তিবাহিনির গেরিলা আক্রমনে পাকিস্তানি সুসজ্জিত হানাদার বাহিনি পরিশেষে তাদের মনোবল হারিয়ে পেলে। এইভাবে মুক্তিবাহিনি তেতুলিয়াতে সদর দপ্তর স্থাপন করে। রংপুর ,বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতিতে তাদের আক্রমন অব্যাহত রাখে। আর ক্রমান্বয়ে মৃক্তিবাহিনির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা ঢাকা, রাজশাহী, নারায়নগঞ্জ এবং খুলনা প্রভৃতি বড় বড় শহরে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির উপর প্রচন্ড আঘাত হানতে শুরু করে।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে তারা যশোর কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা বিস্তৃর্ন এলাকা মুক্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির মনোবল ধ্বংস করে দেয়। আর এমতাবস্তায় পাকিস্তানের সৈরাচারী সরকার উপায় ভাল না দেখে আকস্মিকভাবে ভারতের যোধপুর পাঠানকোট, অমৃতসর এবং আগ্রায় বিমান হামলা চালায় । তাই ভারত ও ভূটান ১৯৭১ সালের একইদিনে ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত প্রদান করে বাংলাদেশকে। পরে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত প্রদান করে। এর পর মুক্তিবাহিনি আর যৌথ বাহিনির সমন্বয়ে গঠিত হয় যৌথকমান্ড।বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির উপর আকাশ পথ, স্থলপথ, এবং জলপথে চলে তীব্র আক্রমন। চতুর্মূখী সম্মিলিত আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনি দূর্বল হয়ে পড়ে । আর মুক্তিবাহিনি ও অনান্য বাহিনির যৌথ অভিযানকে পাকিস্তানি বাহিনি তাদের সর্বশক্তি দিয়ে শেষ করবার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। আর উপায় উত্তর না পেয়ে এদেশের তথা বাঙ্গালী জাতির জ্ঞানী-গুনি, শিক্ষক, চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ক্ষীপ্র হয়ে ওঠে। তাদেরকে হত্যার করার চক্রান্ত শুরু করে।
যেকোন জাতি সেটা বাঙ্গালীই হোক আর যাই হোক তাদের মূল চালিকা শক্তি বা সে সম্প্রদায়কে সামনে এগিয়ে নেয়ার পেছনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন সে জাতির জ্ঞানী গুনি ও বুদ্ধিজীবী গন। পাকিস্তানি বর্বররা বুঝতে পেরেছিল যে এদেশের দামাল ছেলেরা দেশকে হানাদার মুক্ত করতে যেভাবে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে তাদের আর এদেশের মাটিতে শেষ রক্ষা হবেনা। তাই বাঙ্গালী জাতি যাতে পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়াতে না পারে সেজন্যই ১৪ ডিসেম্বর বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। তারা এদেশের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রেষ্ট জ্ঞানী গুনিদের হত্যা করার নীল নকশানুযায়ী রাতের অন্ধকারের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনিদের দূষর রাজাকারদের সহায়তায় অন্ধকারে অপহরণ করে ও হত্যা করে। তাই ১৪ ডিসেম্বর বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে একটি অভিস্মরণীয় দিন। যারা দেশ ও জাতির জন্য অকাতরে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় তারা অমর । তাদের মৃত্যু নেই। জাতি তাদেরকে চিরদিন স্মরন রাখবে।
তাই শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের তথা বাঙ্গালীর জাতির স্মৃতিতে চিরঅমর হয়েই আছে। চির অমর হয়েই থাকবে। এভাবে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১ সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্ভভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘঠে। অবশেষে আমাদের সেই মহান বুদ্ধিজীবি আমাদের লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী যুবকের তাজা রক্ত মা বোনদের ইজ্জত হরন করে ঐ পাকিস্তানী হানাদাররা আর উপায়, উত্তর না পেয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনির সর্বাধিনায়ক নিয়াজী ৯৩ হাজার পাক সৈন্য অস্ত্র সস্ত্র সহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ যৌথবাহিনির সর্বাধিনায়কের নিকট আত্মসমর্পন করে। তাই এই বিজয় দিবস বাঙ্গালীর কাছে তথা বাঙ্গালী জাতি সত্বার কাছে এক মহা মূল্যবান সম্পদ।
এই সম্পদ অর্জন করতে বাঙ্গালী সত্বাকে দিতে হয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা। অনেক মাকে দেখতে হয়েছে মৃত মুখ। হারাতে হয়েছে ইজ্জত। আর এরপর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের বিজয়। আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, পেয়েছি এক লাল সবুজের পতাকা। তাই আমরা প্রতিবছর ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করি।
যারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছেন এবং প্রাণ দিয়েছেন সেই ত্রিশ লক্ষ শহীদদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করি এবং হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা তাদের প্রতি উৎসর্গ করে মহান আল্লার নিকট এই প্রার্থনা করি মহান আল্লাহ যেন তাদেরকে ভাল রাখেন, আল্লাহ তাদের আত্মাকে শান্তিতে রাখেন। আর পূর্বের বিষয়কে মাথায় রেখে পৃথিবীর মধ্যে একটি শ্রেষ্ট জাতি হিসেবে দাড়াবার অঙ্গিকারে আবদ্ধ হই। মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে শ্রেষ্ট জাতিতে পরিণত করেন । আমীন।।
হাফেজ মাওলানা আহসান জামিল
প্রভাষক,আইয়ুব হেনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
খতিব, আইয়ুব হেনা পলিটেকনিক জামে মসজিদ।
মোবাইল: ০১৯১৭-১৫১৮৬৭,০১৭০৩-৭৭১৭০৭
Email.ahsanzamil867@gmail.com