ঢাকা ০১:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




ইয়াবা ও কল্কির নেশায় ভাসছে কেরানীগঞ্জের তরুণরা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১৭ বার পড়া হয়েছে

কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধিঃ 

নদীবেষ্টিত উপজেলা কেরানীগঞ্জে রাতের আঁধার নেমে আসতেই নেশার ভুবনের বাসিন্দা হওয়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠে অনেক তরুণ। তারা বিভিন্ন মাদক আস্তানায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, বাবা আছে? ফেনু আছে? কল্কি আছে? ‘বাবা’ মানে ইয়াবা। ফেনসিডিলের সাংকেতিক নাম ‘ফেনু’। গাঁজা বোঝানোর জন্য বলা হয় ‘কল্কি’। এ উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় চুপিসারে নজর করলে মাদকসেবীদের ব্যাকুলতা ধরা পড়বে। দেখা যাবে চড়া হওয়ায় ওরা ঝুঁকছে বাবার দিকে। নগদ পয়সার জোর যাদের তাদের ভরসা কল্কি। পরিচয় গোপন রেখে এই প্রতিবেদক কয়েকটি মাদক আস্তানায় গিয়েছিলেন। একটি আস্তানায় বিক্রেতা বলেন, ‘ভাই, বাবা ফুরিয়ে গেছে। তখন ক্রেতা তরুণকে বলেন, ‘বাবা যখন নেই কী আর করা? দাও একটা ফেনু।’ বাবায় বেশি আগ্রহ কেন? বিক্রেতা জানান, দুই কারণে- ইয়াবা যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট। দ্বিতীয়ত, ফেনুর চেয়ে দাম কম। কলেজ পড়ুয়া-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়সীরা পর্যন্ত নেশার জালে জড়িয়ে গেছেন। তাই চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন অভিভাবকসহ সচেতন মানুষ। কেরানীগঞ্জে ১২টি ইউনিয়ন।

এসব ইউনিয়নের ৬৫ থেকে ৭০টি স্পটে দেদার বিক্রি হচ্ছে মাদক। এসব স্পটের মধ্যে বাস্তা ইউনিয়নে রয়েছে ৫, রুহিতপুরে ৬, কালিগঞ্জে ৬, তারানগরে ৭, সাক্তায় ৬, কলাতিয়ায় ৮ ও হযরতপুরে ৫টি। এ ছাড়া কোন্ডায় ৭, তেঘরিয়ায় ৩, শুভাড্ডায় ৪, আগানগরে ৩ ও জিনজিরায় ৬টি স্পট। এসব স্পটে পাওয়া যায় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাদকের বিকিকিনি শুরু হয়। এমনকি মহানগরী ঢাকা থেকে অনেক তরুণ মোটরসাইকেলে মাদক সেবনের জন্য চলে আসে। জানতে চাইলে মাদকসেবীরা জানান, বর্তমানে ইয়াবার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কারণ এটি সেবনে নেশা বেশি হয়। গোলাপি বা হালকা লাল রঙের ছোট্ট এই ট্যাবলেটটি এখানকার মাদকসেবী ও বিক্রেতারা সংক্ষিপ্তভাবে ‘বাবা’ সম্বোধন করে। তবে ‘বাবা’ শব্দটি ইয়াবার সাংকেতিক নাম হিসেবে চাউর হয়ে যাওয়ায় আকার ইঙ্গিতে জিপি, হর্সপাওয়ার বা গুটি নামে আদান-প্রদান ও কেনাবেচা হয়। জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের বর্তমানে শীর্ষ পর্যায়ের মাদক কারবারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মান্নান, শাহিন ওরফে ভ্যালকা শাহিন, হাসান, আমিন, স্বপন, জনি, আসলাম, সেন্টু, মুক্তার, কালো দুলাল, ভাসানী, হোসেন মিজি, শফি, শহিদ, ইকবাল, খোকন, রহমান, মো. রাসেল ও আল-আমিন।

দেশের বিভিন্ন স্থানের চেয়ে এ অঞ্চলে ইয়াবার একচেটিয়া মার্কেট তৈরি হয়েছে বলে মাদক ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে। এ অঞ্চলের উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে এই মরণ নেশা এখন অনায়াসে পাওয়া যাচ্ছে। এতে অনেক নেশাখোর ইদানীং ‘মাল’ পরিবর্তন করে এখন নিয়মিত ইয়াবা সেবন করছে। ফলে ফেনসিডিল পুরোপুরি উধাও হওয়ার পথে। এ ছাড়া মাদক কেনাবেচা ও সেবনে যুক্তদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পাঁচ-ছয় বছর আগেও এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিলের রমরমা বাণিজ্য ছিল। উপজেলার জায়গা হয়ে ভারতীয় ফেনসিডিল এখানকার বাজারে পৌঁছত। তখন ইয়াবার নাম অনেকেরই জানা ছিল না। এখানকার মাদকের বাজারে পাওয়া যেত না। হঠাৎ করেই মাদকের বাজার দখল করে নেয় ইয়াবা। ফেনসিডিলসেবীদের কাছে ইয়াবার কদর বেড়ে যাওয়ায় বিক্রেতারাও ব্যবসা পাল্টান। মাদক ব্যবসায়ীরা জানান, ফেনসিডিলের চালান আনার জন্য পিকআপ, প্রাইভেট কার বা ট্রাকের প্রয়োজন হতো। ইয়াবা বহনের জন্য এসব দরকার হয় না। খুব সহজেই ম্যাচ ও সিগারেটের প্যাকেট অথবা মোবাইল ফোন সেটের ভিতরে কৌশলেই শতাধিক থেকে হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করা সম্ভব। মাদক ব্যবসায়ীরা আরও জানান, এ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে প্রতি মাসে ১০ লাখ পিস ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। অন্য এক ইয়াবা সেবনকারী বলেন, আগে ফেনসিডিল খাইতাম। এখন ফেনসিডিল ১০০০-১২০০ টাকা আর ইয়াবা ৩০০-৩৫০ টাকায় পাওয়া যায়। আর ইয়াবা দামে কম ও সহজে পাওয়া যাচ্ছে। তাই ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে অনেকে। মাদকের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অভিযান থাকলেও বর্তমানে কমে গেছে। ইদানীং সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

কেরানীগঞ্জের মাদক স্পটে নিয়মিতভাবে ইয়াবাসহ নানা মাদক কেনাবেচা হয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য প্রতিদিন মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে যান বলেও অভিযোগ রয়েছে। গতকাল আগানগর গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় দালানবাড়ির মাঝে কিছু নিরিবিলি জায়গায় গাছপালা আর ঝোপঝাড়। তার মাঝেই অবস্থান করছিল ১০-১২ জন তরুণ। হাতে তাদের ইয়াবা ও ফেনসিডিল। একটু পরপর সেখানে আনাগোনা বাড়ছিল। আবার মোটরসাইকেল বা হেঁটে অনেককে সেখানে যাওয়া-আসা করতে দেখা যায়। কেউ ঝোপের আড়ালে কেউবা প্রকাশ্যেই সেখানে মাদকের পসরা বসিয়েছিল। যেন মাদকের হাট। এ সময় সেখানে মাদক বিক্রেতা রাজীবের (ছদ্মনাম) সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বলেন, ‘রাজধানীর খুব কাছে তাই তো? আগানগরের নামডাক বেশি। কারা এখানে মাদক বেচে আমি জানি। নাম কমু না। নাম কইছি জানলে হ্যারা মারব।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




ইয়াবা ও কল্কির নেশায় ভাসছে কেরানীগঞ্জের তরুণরা

আপডেট সময় : ০৯:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধিঃ 

নদীবেষ্টিত উপজেলা কেরানীগঞ্জে রাতের আঁধার নেমে আসতেই নেশার ভুবনের বাসিন্দা হওয়ার জন্য উতলা হয়ে ওঠে অনেক তরুণ। তারা বিভিন্ন মাদক আস্তানায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, বাবা আছে? ফেনু আছে? কল্কি আছে? ‘বাবা’ মানে ইয়াবা। ফেনসিডিলের সাংকেতিক নাম ‘ফেনু’। গাঁজা বোঝানোর জন্য বলা হয় ‘কল্কি’। এ উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় চুপিসারে নজর করলে মাদকসেবীদের ব্যাকুলতা ধরা পড়বে। দেখা যাবে চড়া হওয়ায় ওরা ঝুঁকছে বাবার দিকে। নগদ পয়সার জোর যাদের তাদের ভরসা কল্কি। পরিচয় গোপন রেখে এই প্রতিবেদক কয়েকটি মাদক আস্তানায় গিয়েছিলেন। একটি আস্তানায় বিক্রেতা বলেন, ‘ভাই, বাবা ফুরিয়ে গেছে। তখন ক্রেতা তরুণকে বলেন, ‘বাবা যখন নেই কী আর করা? দাও একটা ফেনু।’ বাবায় বেশি আগ্রহ কেন? বিক্রেতা জানান, দুই কারণে- ইয়াবা যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট। দ্বিতীয়ত, ফেনুর চেয়ে দাম কম। কলেজ পড়ুয়া-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়সীরা পর্যন্ত নেশার জালে জড়িয়ে গেছেন। তাই চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন অভিভাবকসহ সচেতন মানুষ। কেরানীগঞ্জে ১২টি ইউনিয়ন।

এসব ইউনিয়নের ৬৫ থেকে ৭০টি স্পটে দেদার বিক্রি হচ্ছে মাদক। এসব স্পটের মধ্যে বাস্তা ইউনিয়নে রয়েছে ৫, রুহিতপুরে ৬, কালিগঞ্জে ৬, তারানগরে ৭, সাক্তায় ৬, কলাতিয়ায় ৮ ও হযরতপুরে ৫টি। এ ছাড়া কোন্ডায় ৭, তেঘরিয়ায় ৩, শুভাড্ডায় ৪, আগানগরে ৩ ও জিনজিরায় ৬টি স্পট। এসব স্পটে পাওয়া যায় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাদকের বিকিকিনি শুরু হয়। এমনকি মহানগরী ঢাকা থেকে অনেক তরুণ মোটরসাইকেলে মাদক সেবনের জন্য চলে আসে। জানতে চাইলে মাদকসেবীরা জানান, বর্তমানে ইয়াবার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কারণ এটি সেবনে নেশা বেশি হয়। গোলাপি বা হালকা লাল রঙের ছোট্ট এই ট্যাবলেটটি এখানকার মাদকসেবী ও বিক্রেতারা সংক্ষিপ্তভাবে ‘বাবা’ সম্বোধন করে। তবে ‘বাবা’ শব্দটি ইয়াবার সাংকেতিক নাম হিসেবে চাউর হয়ে যাওয়ায় আকার ইঙ্গিতে জিপি, হর্সপাওয়ার বা গুটি নামে আদান-প্রদান ও কেনাবেচা হয়। জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের বর্তমানে শীর্ষ পর্যায়ের মাদক কারবারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মান্নান, শাহিন ওরফে ভ্যালকা শাহিন, হাসান, আমিন, স্বপন, জনি, আসলাম, সেন্টু, মুক্তার, কালো দুলাল, ভাসানী, হোসেন মিজি, শফি, শহিদ, ইকবাল, খোকন, রহমান, মো. রাসেল ও আল-আমিন।

দেশের বিভিন্ন স্থানের চেয়ে এ অঞ্চলে ইয়াবার একচেটিয়া মার্কেট তৈরি হয়েছে বলে মাদক ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে। এ অঞ্চলের উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে এই মরণ নেশা এখন অনায়াসে পাওয়া যাচ্ছে। এতে অনেক নেশাখোর ইদানীং ‘মাল’ পরিবর্তন করে এখন নিয়মিত ইয়াবা সেবন করছে। ফলে ফেনসিডিল পুরোপুরি উধাও হওয়ার পথে। এ ছাড়া মাদক কেনাবেচা ও সেবনে যুক্তদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পাঁচ-ছয় বছর আগেও এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিলের রমরমা বাণিজ্য ছিল। উপজেলার জায়গা হয়ে ভারতীয় ফেনসিডিল এখানকার বাজারে পৌঁছত। তখন ইয়াবার নাম অনেকেরই জানা ছিল না। এখানকার মাদকের বাজারে পাওয়া যেত না। হঠাৎ করেই মাদকের বাজার দখল করে নেয় ইয়াবা। ফেনসিডিলসেবীদের কাছে ইয়াবার কদর বেড়ে যাওয়ায় বিক্রেতারাও ব্যবসা পাল্টান। মাদক ব্যবসায়ীরা জানান, ফেনসিডিলের চালান আনার জন্য পিকআপ, প্রাইভেট কার বা ট্রাকের প্রয়োজন হতো। ইয়াবা বহনের জন্য এসব দরকার হয় না। খুব সহজেই ম্যাচ ও সিগারেটের প্যাকেট অথবা মোবাইল ফোন সেটের ভিতরে কৌশলেই শতাধিক থেকে হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করা সম্ভব। মাদক ব্যবসায়ীরা আরও জানান, এ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে প্রতি মাসে ১০ লাখ পিস ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। অন্য এক ইয়াবা সেবনকারী বলেন, আগে ফেনসিডিল খাইতাম। এখন ফেনসিডিল ১০০০-১২০০ টাকা আর ইয়াবা ৩০০-৩৫০ টাকায় পাওয়া যায়। আর ইয়াবা দামে কম ও সহজে পাওয়া যাচ্ছে। তাই ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে অনেকে। মাদকের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অভিযান থাকলেও বর্তমানে কমে গেছে। ইদানীং সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

কেরানীগঞ্জের মাদক স্পটে নিয়মিতভাবে ইয়াবাসহ নানা মাদক কেনাবেচা হয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য প্রতিদিন মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে যান বলেও অভিযোগ রয়েছে। গতকাল আগানগর গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় দালানবাড়ির মাঝে কিছু নিরিবিলি জায়গায় গাছপালা আর ঝোপঝাড়। তার মাঝেই অবস্থান করছিল ১০-১২ জন তরুণ। হাতে তাদের ইয়াবা ও ফেনসিডিল। একটু পরপর সেখানে আনাগোনা বাড়ছিল। আবার মোটরসাইকেল বা হেঁটে অনেককে সেখানে যাওয়া-আসা করতে দেখা যায়। কেউ ঝোপের আড়ালে কেউবা প্রকাশ্যেই সেখানে মাদকের পসরা বসিয়েছিল। যেন মাদকের হাট। এ সময় সেখানে মাদক বিক্রেতা রাজীবের (ছদ্মনাম) সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বলেন, ‘রাজধানীর খুব কাছে তাই তো? আগানগরের নামডাক বেশি। কারা এখানে মাদক বেচে আমি জানি। নাম কমু না। নাম কইছি জানলে হ্যারা মারব।’