সরকারী টাকায় গাড়ি কেনায় তেলেস্মতি!
- আপডেট সময় : ০৮:৫৬:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৩৮ বার পড়া হয়েছে
৩০ লাখের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে ১০ লাখ টাকা, প্রতি মাসে পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা, প্রতিমন্ত্রী বললেন, বিষয়টি আমাদের নলেজে এসেছে
সকালের সংবাদ ডেস্ক;
আমলাদের গাড়ি কেনার জন্য সুদবিহীন ঋণ দেয় সরকার। গাড়ি কেনার পর সেই গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে ওই কর্মকর্তাদের দিচ্ছে নগদ ৫০ হাজার টাকা করে। আবার গাড়ি কেনার পুরো টাকাও পরিশোধ করতে হবে না। নানান কারণে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সেই ঋণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের টাকা দিয়ে সরকারের কোনো লাভই হচ্ছে না। বরং লাভ হচ্ছে আমলাদের। সরকারি কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশই সরকারের দেওয়া ঋণের টাকায় গাড়ি কিনে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। কেউবা পরিবারের সদস্যদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য বাসায় রেখে আসছেন। ঋণের টাকার গাড়ি অফিসের কাজে ব্যবহার না করে তারা সরকারের পরিবহনপুলের গাড়িই ব্যবহার করছেন। এই বিষয়টিকে মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না সরকারের বর্তমান এবং সাবেক অনেক আমলা। তারা বলছেন, সরকার কাজের গতি বাড়াতে কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা দিলেও কর্মকর্তারা সেই সুযোগ-সুবিধার যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন। যা মোটেই কাম্য নয়। বিষয়টি খোদ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেনও অবগত আছেন। জানতে চাইলে তিনি গত বুধবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নলেজে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অবগত আছেন। তাকে পুরো বিষয়টি জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন যারা সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে সেই গাড়ি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা অন্য কাজে ব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যারা গাড়ি অফিসের কাজে ব্যবহার করছে না এরকম কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যে খোঁজ নিতে শুরু করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, এটা পুরোপুরি বেআইনি, ক্ষমতার অপব্যবহার। সরকারি অর্থের অপচয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা উচিত। তিনি বলেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাইলে এই অপব্যবহার ১৫ দিনে বন্ধ করা সম্ভব। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম মেয়াদেই ২০১২-১৩ সালের দিকে প্রথমে সরকারের অতিরিক্ত সচিবদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। এরপর সেই সুবিধা পান যুগ্ম সচিবরা। সব শেষে উপ-সচিবরাও এই সুযোগ আদায় করে নেন। সরকার প্রশাসনের কাজের গতি আরও বাড়াতে সবাইকে গাড়ি কেনার সুবিধা দেয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৪৭২ জন, যুগ্ম সচিব আছেন ৮৪৪ জন এবং উপ-সচিব এক হাজার ৭০০ জন। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কর্মকর্তাই প্রশাসন ক্যাডারের এবং তাদের প্রায় সবাই ইতিমধ্যে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। আর যারা এখনো গাড়ি কিনেননি তারা গাড়ি কেনার প্রক্রিয়ায় আছেন। গাড়ি কেনার সুবিধা পাচ্ছেন শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এবং গাড়ি সংক্রান্ত নীতিমালা থেকে জানা গেছে, গাড়ির জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হলেও পরিশোধের ক্ষেত্রে গাড়ির প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরকে পরিশোধ করতে হবে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা। কারণ প্রতি বছর গাড়ির আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ায় ১০ শতাংশ হারে টাকা কম পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া টাকা পরিশোধের কোনো সময়সীমাও নেই। এ হিসেবে দেখা যায়, উপ-সচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব মিলিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় দুই হাজার ৭০০ কর্মকর্তা গাড়ি নিয়েছেন সুদবিহীন সরকারি ঋণে। এতে তাদের পিছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের পরিশোধ করতে হবে প্রায় পৌনে তিনশ কোটি টাকারও কম। আর প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার বেশি যাবে সরকারের তহবিল থেকে।
প্রশাসনের সূত্রগুলো বলছে, পরিবহন পুলের যানবাহন স্বল্পতার কারণে সরকার প্রথম দফায় অতিরিক্ত সচিবদের গাড়ি কিনতে সুদ বিহীন ঋণ সুবিধা দেয়। প্রত্যেককে ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি মাসে চালক, জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে আরও ৫০ হাজার টাকা করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রদান করে। একইভাবে সরকার যুগ্ম সচিবদেরকেও গাড়ি কেনার সুবিধা দেয়। সর্বশেষ উপ-সচিবরাও একই সুবিধা পান। কিন্তু এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও সরকার তার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সার্ভিসটুকু পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। খোদ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাই এই অভিযোগ তুলেছেন।
দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব থেকে শুরু করে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের একটা বড় অংশই গাড়ি সুবিধা নিয়ে সেই গাড়ি ব্যবহার করছেন না। এমনকি একই পরিবারের দুই কর্মকর্তা গাড়ি নিয়েও সেই গাড়ি ব্যবহার না করে সরকারি দফতরের গাড়ি ব্যবহার করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই অনেক কর্মকর্তা সরকারের দেওয়া ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি ব্যবহার না করে এখনো সকালে অফিসে আসেন বিভিন্ন অধিদফতর, পরিদফতর, সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগীর গাড়ি ব্যবহার করে। অফিস থেকে ফেরার পথে এসব কর্মকর্তা একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
বিমান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর অদূরে একটি এলাকা থেকে তিনি নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে প্রতিদিন অফিসে আসেন। তার গাড়িতে ওই এলাকায় বসবাসকারী অন্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও নিয়মিত সচিবালয়ে আসেন। একাধিক দিন ওই অতিরিক্ত সচিবকে ঋণের টাকায় কেনা তার গাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও ওই কর্মকর্তা কোনো জবাব দেন না।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের একান্ত সচিব সারওয়ার হোসেন ও প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের একান্ত সচিব হেমন্ত হেনরী কুবি দুজনেই গাড়ির জন্য ঋণ নিয়েছেন। গাড়িও কিনেছেন। কিন্তু তারা কেউই সেই গাড়ি অফিসের কাজে ব্যবহার করেন না। তারা অফিসে যাতায়াত করেন পরিবহন পুলের গাড়িতে। একইভাবে এই মন্ত্রণালয়ের অন্তত দুজন অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন যারা ঋণের টাকায় কেনা গাড়িতে যাতায়াত করেন না। একই চিত্র সরকারের সড়ক পরিবহন বিভাগে। এখানে অনেক কর্মকর্তাই অফিসে যাতায়াত করেন দফতর, অধিদফতরের গাড়িতে। নিজের গাড়ি হয় বাসায় রেখে আসেন নতুবা অন্য কোথাও ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। এখানে কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ সরকারের দেওয়া ঋণের টাকায় গাড়ি কিনলেও সেই গাড়ি ব্যবহার না করে এখনো সরকারি কিংবা বিভিন্ন দফতর ও সংস্থার গাড়িতে আসা-যাওয়া করছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের চিত্রও একই রকম।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির এক্সসিলেটরিং প্রটেকশন ফর চিলড্রেন (এপিসি) প্রকল্পে পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন সরকারের একজন উপ-সচিব এম এ লতিফ। তিনি সরকার থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় গাড়ি কিনেছেন। কিন্তু তার সেই গাড়ি বাসাতেই ব্যবহার হয়। তিনি প্রকল্পের দুটি গাড়ি ব্যবহার করেন। যার একটি হচ্ছে ল্যান্ড ক্রোজার প্রাডো, নম্বর- ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫১৯৫। অন্যটি হচ্ছে ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৩০১৭। এটিও জিপ গাড়ি। এরকম আরও বহু কর্মকর্তা রয়েছেন যারা সরকারের দেওয়া ঋণের টাকায় গাড়ি কিনে অন্য কাজে ব্যবহার করছেন। তদারকির অভাবে এই সংখ্যা এখন অনেক দীর্ঘ।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের মন্ত্রণালয়ে অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি ব্যবহার না করে সরকারি পরিবহনপুলের গাড়ি ব্যবহার করতেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে গাড়ির মেইনটেনেন্স বাবদ দেওয়া ৫০ হাজার টাকা নিতে ভুল করেন না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমার অনেক ব্যাচমেটকে তো দেখি সরকারি গাড়িতেই যাতায়াত করছেন। সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন, সুবিধাও নিচ্ছেন আবার সরকারের গাড়িও ব্যবহার করছেন। তাহলে তো গাড়ির জন্য ঋণ দিয়ে সরকারের কোনো লাভ হলো না।
নীতিমালায় যা আছে : সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০১৭ (সংশোধিত) এর প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বিশেষ অগ্রিম নিয়ে গাড়ি কেনার পরিবহন কমিশনারের ছাড়পত্র গ্রহণপূর্বক পরবর্তী মাস থেকে গাড়ি মেরামত/সংরক্ষণ, জ্বালানি, চালকের বেতন ইত্যাদি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া অর্থ (প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে উত্তোলন করবেন।
নীতিমালায় গাড়ির ব্যবহার বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো কর্মকর্তার দাফতরিক কার্যালয় যে স্থানে অবস্থিত তার আট কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সরকারি কাজে ভ্রমণের জন্য ওই কর্মকর্তা কোনো টিএ/ডিএ দাবি করতে পারবেন না। কোনো কর্মকর্তা চাকরিতে থাকাবস্থায় দাফতরিক প্রয়োজন শেষে গাড়িটি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গাড়ি ব্যবহার বিষয়ে দূরত্ব সংক্রান্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
নীতিমালায় সরকারি গাড়ি রিকুইজিশন নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে, বিশেষ অগ্রিম সুবিদা গ্রহণকারী কোনো কর্মকর্তা সাধারণভাবে তার দফতর হতে রিকুইজিশন ভিত্তিতে কোনো গাড়ি সরকারি বা ব্যক্তিগত প্রয়োজন ব্যবহার করতে পারবেন না।
সরকারের কর্মকর্তাদের গাড়ি প্রদানের বিষয়ে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, গাড়ির প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরকারি দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে সরকারি গাড়ির পরিবর্তে গাড়ি ক্রয়ের জন্য ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সরকারি গাড়ির আয়ুষ্কাল হচ্ছে আট বছর। এ কারণে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে অবচয় বাদ দিয়ে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে গাড়ির বন্ধককাল শেষ হবে। এক্ষেত্রে রিকন্ডিশন গাড়ির ক্ষেত্রে প্রথম বছর থেকেই এই অবচয় সুবিধা পাবেন ঋণ গ্রহীতা কর্মকর্তারা। আর ঋণ পরিশোধ হওয়ার পরই গাড়িটির মালিক হবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তার আগ পর্যন্ত গাড়িটি সরকারি হিসেবেই গণ্য হবে।