ঢাকা ০৬:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ




গ্যাং কালচারে ভয়ঙ্কর কিশোর অপরাধ!

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৫০:৩০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৮০ বার পড়া হয়েছে

সকালের সংবাদঃ  পরনে টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। চুলে নিত্যনতুন স্টাইল। পাড়া, মহল্লা, অলিগলি ও ফুটপাতে জমিয়ে আড্ডা দেয় তারা। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দামি লাইটার দিয়ে ধরিয়ে হিরোদের মতো দেয় টান। উচ্চস্বরে গায় হিন্দি কিংবা ইংরেজি গান। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো বয়স বিবেচনা নেই তাদের। রাত বাড়লেই রাজধানীর অভিজাত এলাকায় শুরু হয়ে যায় এমন ‘ডিসকো পোলাদের’ মোটর ও কার রেসিং। এলাকাভেদে এদের রয়েছে পৃথক গ্রুপ। একেকটি গ্রুপকে ‘গ্যাং’ বলা হয়।

লাড়া দে, ডিসকো বয়েজ, নাইন স্টার, ফিফটিন, ব্ল্যাক রোজ, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপারসহ এরকম শতাধিক নামের গ্যাং গ্রুপের কয়েক হাজার কিশোর এখন গোটা রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদের অনেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অধিকাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় দণ্ডবিধি অনুযায়ী পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাদেরকে আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হয়। অথচ ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

যেভাবে শুরু: র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাং কালচারের যাত্রা শুরু হয় ২০০১ সালে। মূলত মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচন্ড গতিতে মোটর বা কার রেসিং করা, খেলার মাঠ নিয়ন্ত্রণ করা, দেয়ালে চিকা মেরে নিজেদের পাওয়ার বা অবস্থান জানান দেওয়া, এমনকি মাদক গ্রহণ প্রভৃতি কর্মকান্ড ঘিরে গড়ে ওঠেছে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ। রাজধানীর বাড়ি, অফিস ও সরকারি স্থাপনার দেয়ালে লক্ষ্য করলে এদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। একাধিক দেয়ালে বিশেষ কায়দায় বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের নাম লেখা রয়েছে। পাল্টাপাল্টি হুমকি দিয়ে দেয়ালে লেখা বিভিন্ন গ্রুপের শ্লোগান। এসব শ্লোগান গ্যাং গ্রুপের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ঝগড়া-বিবাদের তথ্য জানান দেয়। আবার ফেসবুকেও এদের পেজ রয়েছে। ওই সব পেজে গ্রুপের সদস্যরা সারাদিন অশ্লীল ভাষায় তথ্য আদান-প্রদান করে। একপর্যায়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে হত্যার মতো অপরাধে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। এই হিরোইজমকে সঠিক পথের অনুসারী করে তুলতে হবে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরণের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। এর দায় আমাদের সবার। অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি ইচ্ছামত তাদের আয়ত্বে চলে যাওয়ায় কিশোরদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে-এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এই গ্যাং কালচার থেকে বিপদগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন, ধরপাকড় : ২০১৫ সালের ২৭শে মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র অনিককে (১৫)। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদত্নান কবির। আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ধানমন্ডি, মিরপুর, হাজারীবাগ, বংশাল, লালবাগ, তাঁতীবাজার, ওয়ারী, মোহাম্মদপুর, আদাবর, কল্যাণপুর, পল্লবীসহ অন্তত ২০ এলাকায় সবচেয়ে বেশি আধিপত্য এদের। কিছুদিনের জন্য গ্যাংগুলো আড়ালে চলে গেলেও চলতি বছরের প্রথম দিকে ফেসবুকে আবারও ফিরে আসে ঘোষণা দিয়ে। আবারও শুরু হয় খুনোখুনি।

চলতি বছরের ২৯ জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সী ইয়াছিন আরাফাত ও ৭ জুলাই গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শাওন খুন হয়। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং গ্রুপে বড়-ছোট (সিনিয়র-জুনিয়র) দ্বন্দ্বের জেরে শাওন ও ইয়াছিন খুন হয়েছে। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। পুলিশ ও র্যাব পৃথক অভিযান চালাতে থাকে। র্যাব ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বংশাল, তাঁতীবাজার, শাখাঁরীবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ এবং সূত্রাপুরে অভিযান চালিয়ে গ্যাং গ্রুপের ৫৮ জনকে আটকের পর আদালতে হাজির করে। তাদেরকে টঙ্গী শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উত্তরায় হাউস বিল্ডিং এলাকা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ ফার্স্ট হিটার বস (এফএইচবি) নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের ১৪ সদস্যকে আটক করা হয়। জিগাতলা, সাতমসজিদ রোড, আদাবর এবং মিরপুরে অভিযান চালিয়ে গ্যাং গ্রুপের ৩৩ জন কিশোরকে আটক করা হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে চলমান এই অভিযানের মধ্যে বুধবার রাতে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে কিশোর গ্যাং গ্রুপের দ্বন্দ্বে মহসিন নামে এক কিশোর খুন হয়। পুলিশ বলছে, নিহত মহসিন ও ঘাতক পারভেজের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছাড়াও ছিল কিশোর গ্যাং নিয়ে কোন্দল। পারভেজ ছিল ‘আতঙ্ক’ নামক গ্রুপের নেতৃস্থানীয়। নিহত মহসিন ‘ফিল্ম ঝিরঝির’ গ্রুপের সদস্য।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, কিশোরদের মধ্যেই ‘এডভেনচার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব বেশি দেখা যায়। কিশোর বয়সে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তাকে অপরাধী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তারা এই বয়সে এমন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলো করে- সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। কিশোর বয়সে ইতিবাচক চর্চার দিকে ধাবিত না হয়ে নেতিবাচক চর্চার দিকে চলে যায়। আবার যখন তারা দেখে যে অপরাধ যারা করছে তারা সমাজে বেশি লাভবান হচ্ছে, সেটা কিশোররা অনুসরণ করে। তাদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। গরিব ও ধনী-দুই শ্রেণির পরিবারের কিশোরদের মধ্যেই এই গ্যাং কালচারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিশোরদের গ্যাং কালচার থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড়ো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এদেরকে সংশোধন করতে সর্বপ্রথম অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর রাখলে তাদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকার বাইরেও :এদিকে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায়ও রয়েছে ২০-২৫ টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে অন্তত ছয়টি গ্যাং। মাদক, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই গ্যাংয়ের কিশোররা। এর জের ধরেই গত বছরের জানুয়ারিতে জামাল খান এলাকায় হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান ইসফারকে। একইভাবে ওই বছরের জানুয়ারিতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে খুলনা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শেখ ফাওমিদ তানভীর রাজিমকে। খুলনা শহরে কিশোরদের অন্তত সাতটি গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে ভয়ঙ্কর গ্যাংগুলো হচ্ছে স্টার বয়েজ, হিরো বয়েজ, ডেঞ্জার বয়েজ, গোল্ডেন বয়েজ ও টিপসি। সিলেট শহরেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে কিশোরদের সাত-আটটি গ্যাং। দামি মোটরসাইকেলে করে শহরে ঘুরে বেড়ানো, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, মাদকসেবনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




গ্যাং কালচারে ভয়ঙ্কর কিশোর অপরাধ!

আপডেট সময় : ০৮:৫০:৩০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সকালের সংবাদঃ  পরনে টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। চুলে নিত্যনতুন স্টাইল। পাড়া, মহল্লা, অলিগলি ও ফুটপাতে জমিয়ে আড্ডা দেয় তারা। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দামি লাইটার দিয়ে ধরিয়ে হিরোদের মতো দেয় টান। উচ্চস্বরে গায় হিন্দি কিংবা ইংরেজি গান। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো বয়স বিবেচনা নেই তাদের। রাত বাড়লেই রাজধানীর অভিজাত এলাকায় শুরু হয়ে যায় এমন ‘ডিসকো পোলাদের’ মোটর ও কার রেসিং। এলাকাভেদে এদের রয়েছে পৃথক গ্রুপ। একেকটি গ্রুপকে ‘গ্যাং’ বলা হয়।

লাড়া দে, ডিসকো বয়েজ, নাইন স্টার, ফিফটিন, ব্ল্যাক রোজ, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপারসহ এরকম শতাধিক নামের গ্যাং গ্রুপের কয়েক হাজার কিশোর এখন গোটা রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদের অনেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অধিকাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় দণ্ডবিধি অনুযায়ী পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাদেরকে আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হয়। অথচ ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

যেভাবে শুরু: র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাং কালচারের যাত্রা শুরু হয় ২০০১ সালে। মূলত মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচন্ড গতিতে মোটর বা কার রেসিং করা, খেলার মাঠ নিয়ন্ত্রণ করা, দেয়ালে চিকা মেরে নিজেদের পাওয়ার বা অবস্থান জানান দেওয়া, এমনকি মাদক গ্রহণ প্রভৃতি কর্মকান্ড ঘিরে গড়ে ওঠেছে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ। রাজধানীর বাড়ি, অফিস ও সরকারি স্থাপনার দেয়ালে লক্ষ্য করলে এদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। একাধিক দেয়ালে বিশেষ কায়দায় বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের নাম লেখা রয়েছে। পাল্টাপাল্টি হুমকি দিয়ে দেয়ালে লেখা বিভিন্ন গ্রুপের শ্লোগান। এসব শ্লোগান গ্যাং গ্রুপের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ঝগড়া-বিবাদের তথ্য জানান দেয়। আবার ফেসবুকেও এদের পেজ রয়েছে। ওই সব পেজে গ্রুপের সদস্যরা সারাদিন অশ্লীল ভাষায় তথ্য আদান-প্রদান করে। একপর্যায়ে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে হত্যার মতো অপরাধে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। এই হিরোইজমকে সঠিক পথের অনুসারী করে তুলতে হবে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরণের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। এর দায় আমাদের সবার। অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি ইচ্ছামত তাদের আয়ত্বে চলে যাওয়ায় কিশোরদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে-এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এই গ্যাং কালচার থেকে বিপদগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন, ধরপাকড় : ২০১৫ সালের ২৭শে মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র অনিককে (১৫)। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদত্নান কবির। আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ধানমন্ডি, মিরপুর, হাজারীবাগ, বংশাল, লালবাগ, তাঁতীবাজার, ওয়ারী, মোহাম্মদপুর, আদাবর, কল্যাণপুর, পল্লবীসহ অন্তত ২০ এলাকায় সবচেয়ে বেশি আধিপত্য এদের। কিছুদিনের জন্য গ্যাংগুলো আড়ালে চলে গেলেও চলতি বছরের প্রথম দিকে ফেসবুকে আবারও ফিরে আসে ঘোষণা দিয়ে। আবারও শুরু হয় খুনোখুনি।

চলতি বছরের ২৯ জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সী ইয়াছিন আরাফাত ও ৭ জুলাই গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শাওন খুন হয়। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং গ্রুপে বড়-ছোট (সিনিয়র-জুনিয়র) দ্বন্দ্বের জেরে শাওন ও ইয়াছিন খুন হয়েছে। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। পুলিশ ও র্যাব পৃথক অভিযান চালাতে থাকে। র্যাব ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বংশাল, তাঁতীবাজার, শাখাঁরীবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ এবং সূত্রাপুরে অভিযান চালিয়ে গ্যাং গ্রুপের ৫৮ জনকে আটকের পর আদালতে হাজির করে। তাদেরকে টঙ্গী শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উত্তরায় হাউস বিল্ডিং এলাকা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ ফার্স্ট হিটার বস (এফএইচবি) নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের ১৪ সদস্যকে আটক করা হয়। জিগাতলা, সাতমসজিদ রোড, আদাবর এবং মিরপুরে অভিযান চালিয়ে গ্যাং গ্রুপের ৩৩ জন কিশোরকে আটক করা হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে চলমান এই অভিযানের মধ্যে বুধবার রাতে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে কিশোর গ্যাং গ্রুপের দ্বন্দ্বে মহসিন নামে এক কিশোর খুন হয়। পুলিশ বলছে, নিহত মহসিন ও ঘাতক পারভেজের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছাড়াও ছিল কিশোর গ্যাং নিয়ে কোন্দল। পারভেজ ছিল ‘আতঙ্ক’ নামক গ্রুপের নেতৃস্থানীয়। নিহত মহসিন ‘ফিল্ম ঝিরঝির’ গ্রুপের সদস্য।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, কিশোরদের মধ্যেই ‘এডভেনচার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব বেশি দেখা যায়। কিশোর বয়সে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তাকে অপরাধী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তারা এই বয়সে এমন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলো করে- সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। কিশোর বয়সে ইতিবাচক চর্চার দিকে ধাবিত না হয়ে নেতিবাচক চর্চার দিকে চলে যায়। আবার যখন তারা দেখে যে অপরাধ যারা করছে তারা সমাজে বেশি লাভবান হচ্ছে, সেটা কিশোররা অনুসরণ করে। তাদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। গরিব ও ধনী-দুই শ্রেণির পরিবারের কিশোরদের মধ্যেই এই গ্যাং কালচারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিশোরদের গ্যাং কালচার থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড়ো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এদেরকে সংশোধন করতে সর্বপ্রথম অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর রাখলে তাদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকার বাইরেও :এদিকে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায়ও রয়েছে ২০-২৫ টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে অন্তত ছয়টি গ্যাং। মাদক, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই গ্যাংয়ের কিশোররা। এর জের ধরেই গত বছরের জানুয়ারিতে জামাল খান এলাকায় হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান ইসফারকে। একইভাবে ওই বছরের জানুয়ারিতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে খুলনা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শেখ ফাওমিদ তানভীর রাজিমকে। খুলনা শহরে কিশোরদের অন্তত সাতটি গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে ভয়ঙ্কর গ্যাংগুলো হচ্ছে স্টার বয়েজ, হিরো বয়েজ, ডেঞ্জার বয়েজ, গোল্ডেন বয়েজ ও টিপসি। সিলেট শহরেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে কিশোরদের সাত-আটটি গ্যাং। দামি মোটরসাইকেলে করে শহরে ঘুরে বেড়ানো, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, মাদকসেবনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।