আবেদ-জাবেদ দুই ভাই সরকারী বাড়ি ভাগে খাই!
- আপডেট সময় : ০৮:৪৯:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২৫ বার পড়া হয়েছে
সরকারী সম্পত্তি দখল করে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে শত কোটি টাকার ফ্লাট বানিজ্য করেন পুরান ঢাকার বিএনপির আমলে দুর্ধর্ষ ক্যাডার আবেদ ও জাবেদ দুই ভাই।বর্তমানে মেয়র সাইদ খোকনের এক আত্মীয়ের প্রভাব খাঁটিয়ে বহাল তবিয়াতে তারা।আওয়ামীলীগ সাঁজতে কৌশল হিসেবে নামের আগে শেখ জুড়ে দিয়েছেন।
হাফিজুর রহমানঃ বিএনপির শাসনামলে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন দুই ভাই । খোকা ও তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ নাসির উদ্দিন পিন্টুর প্রভাবকে পুঁজি করে জাল দলিলপত্র তৈরি করে অর্পিত সম্পত্তিও দখল করতেন জাবেদ ও আবেদ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুজন তাদের নামের আগে ‘শেখ’ শব্দটি যুক্ত করেন; বনে যান নব্য আওয়ামী লীগার এবং চালিয়ে যেতে থাকেন পুরনো অপকর্ম। শত শত কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তি একের পর এক হয়ে গেলেও ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এদিকে কোন নজর নেই। বরং কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ তুললে বা নজরে আনার চেষ্টা করলেও জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তা খতিয়ে দেখতে কিংবা পদক্ষেপ নিতে যেন মোটেই আগ্রহী নন। এর কারণ, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিজেরাই এসব দখল কর্মকাণ্ডে নেপথ্য থেকে সহযোগিতা এবং এসব সরকারি বাড়ি, প্লট, সম্পত্তি দখল ও বিক্রির ভাগবাটোয়ারায় মোটা অংকের অর্থ পান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এর আগে পুরান ঢাকায় সরকারি প্লট এবং বাড়িগুলো বেহাত হওয়া সম্পর্কে যে প্রতিবেদন করা হয়েছে এ সম্পত্তিগুলোর প্রত্যেকটিই সরকারি গেজেট ও সরকারের অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় আছে। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রকাশিত গেজেটও এ প্রতিবেদকের হাতে আছে। কিন্তু কাগজপত্রে বা গেজেটে সরকারের মালিকানা থাকলেও ভূমিদস্যুরা এ বাড়িগুলো জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে।
পুরান ঢাকা সম্পর্কে সরকারের মালিকানাধীন অর্পিত সম্পত্তির তালিকা সর্বশেষ ২০১২ সালের ৬ মে গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এই গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত এই গেজেটের ১২০ নং ক্রমিকে নবাবপুর রোডের ২৩৪ এবং ২৩৫ হোল্ডিংয়ের কথা উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়, ইপি কেস নং ২৭/৭২ এর মাধ্যমে এই সম্পত্তিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকেই এই সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ও ভোগদখল করে আসছিলো সরকার। এখানে ৭টি দাগে মোট .১৬৮৯ একর সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া গেজেটের ৩২০ নং ক্রমিকে ২৩৪ নবাবপুর রোডের ৬টি দাগে আরো .১৪০৬ একর সম্পত্তি অর্পিত বলে উল্লেখ রয়েছে। এটিরও কেস নম্বর একই এবং ১৯৭২ থেকে সরকারের দখলে রয়েছে। কিন্তু, ২০১২ সালের গেজেটে মালিকানা ও দখল সরকারের হাতে রয়েছে বলে উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে এটির দখল আর সরকারের হাতে নেই।
জাবেদ-আবেদের নেতৃত্বাধীন জালিয়াত ও দখলবাজ চক্র ইতিমধ্যে এই অতি মূল্যবান সম্পত্তিটি দখল করে জাল ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এর উপর ৭ তলা বিশিষ্ট ‘জাবিন টাওয়ার‘ নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করেছে। দোকান ও ফ্ল্যাট আকারে এই ভবন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রিও করে দিয়েছে।
গেজেটের ১২৪ নম্বর ক্রমিকে উল্লেখ রয়েছে ২২২ হোল্ডিংয়ের নবাবপুর রোডের পাকা বাড়িটির কথা। এখানে সরকারের মোট ১২ শতাংশ সম্পত্তি রয়েছে। ইপি কেস নং ৮০/৬৯ এর মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে এই সম্পত্তিটি ‘অর্পিত সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৬ জুন, ১৯৬৯ তারিখে এই সম্পত্তিটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। সেই থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে লিজ দিয়ে লিজ মানিও আদায় করছিলো সরকার।
২০১২ সালে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত এটি সরকারের দখলেই ছিলো। ভূমি জরিপ অধিদফতরের রেকর্ডেও সরকারের অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দেখানো আছে। অথচ, এরপর দুই ভাইয়ের জালিয়াতচক্র সরকারি সম্পত্তিটি জোরপূর্বক দখলে নিয়ে এখানকার পুরাতন ভবন ভেঙে বহুতলা বিশিষ্ট ভবন ‘মরিয়ম টাওয়ার’ নির্মাণ শুরু করেছে। নির্মীয়মান এই টাওয়ারের দোকান ও ফ্ল্যাট বিক্রির কাজও চালিয়ে যাচ্ছে একই সঙ্গে।
ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত গেজেটের ৯৩ নং ক্রমিকে উল্লেখ আছে নবাবপুর রোডের ২২৯ হোল্ডিংয়ের কথা। সাড়ে ৬ শতাংশ জমির ওপর তৈরি করা এই বাড়িটি ১৯৬০ সালে ইপি কেস নং ৯০৬/৬০ এর মাধ্যমে সরকারের অর্পিত সম্পত্তিতে তালিকাভুক্ত হয়।
১১ মে, ১৯৭২ সালে এই সম্পত্তির দখল এবং নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে আসে। ২০১২ সালে গেজেট প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত এটি তা-ই ছিলো। অর্থাৎ এ সময় পর্যন্ত সরকার লিজ দিয়ে লিজ মানি আদায় করছিলো। ভূমি জরিপ অধিদফতরের রেকর্ডে এখনো এটি অপিত সম্পত্তি হিসেবে দেখানো আছে। কিন্তু, কাগজপত্রে সরকারের মালিকানা থাকলেও ইতিমধ্যে চলে গেছে সন্ত্রাসী ও জালিয়াতচক্রের হাতে। জাবেদ-আবেদ এখানকার পুরাতন ভবনটি ভেঙে এখানে ইতিমধ্যে ‘ড্রয়েলিং পয়েন্ট’ নামে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রিও করে দিয়েছে।
নবাবপুর রোডের ৮৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের সম্পত্তিটি ইপি কেস নং ১৩০৮/৬৩ এর মাধ্যমে সরকারের অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এখানে দুটি দাগে মোট ১১ শতাংশ জমির ওপর পাকা বাড়ি থাকা অবস্থায় ১৮ জুন, ১৯৭৫ সালে এই সম্পত্তিটি সরকারের দখলে আসে। ২০১২ সালে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত এটি সরকারের দখল এবং মালিকানায় ছিলো। গেজেটের ৭১৭ নম্বর ক্রমিকে এই সম্পত্তির কথা উল্লেখ আছে। ভূমি অফিসের রেকর্ডেও তা-ই আছে। কিন্তু, কাগজপত্রে এখনো সরকার মালিক হলেও দখল ইতিমধ্যে জালিয়াতচক্র এবং দখলবাজ জাবেদ-আবেদের হাতে চলে গেছে। তারা পুরাতন ভবন ভেঙে এখানে ‘সাজেদা আলী প্লাজা’ মার্কেট নির্মাণ করেছে।
নবাবপুর রোডের ৫৫/৫৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের সম্পত্তির মালিক সরকার ১৯৬৮ সাল থেকেই। ইপি কেস নং ১৮৮/৬৮ এর মাধ্যমে ওই সময় এটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এই সম্পত্তি সরকারের দখলে নেয়া হয় ২৯ মার্চ, ১৯৮৩ সালে। ভূমি অফিসের রেকর্ড এবং ২০১২ সালের প্রকাশিত গেজেট অনুসারে এখনো সরকার এই সম্পত্তির মালিক ও দখলদার হিসেবে আছে। অর্পিত সম্পত্তি সম্পর্কিত সরকারি গেজেটের ১০৬০ নং ক্রমিকে এই সম্পত্তির কথা এভাবেই উল্লেখ আছে। কিন্তু, জাবেদ-আবেদ সম্প্রতি এই সম্পত্তি দখল করে এখানকার পুরাতন ভবন ভেঙে বহুতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করে।
নরেন্দ্র বসাক লেনের ৫০ নম্বর হোল্ডিংয়ের সরকারি মালিকানাধীন অর্পিত সম্পত্তিটিও সম্প্রতি দখলে নিয়ে এখানে নতুন ভবন নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে জাবেদ-আবেদ। বর্তমানে নতুন ভবনের বেজমেন্টের কাজ চলছে। অথচ ২০১২ সালে প্রকাশিত ভূমি মন্ত্রণালয়ের গেজেটের ৯৩৯ নম্বর ক্রমিকে এটিকে অর্পিত সম্পত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গেজেটে বলা হয়, ইপি কেস নং ২৫/৬৮ এর মাধ্যমে ১৯৬৮ সালে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে এই সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই সম্পত্তি সরকারের দখলে নেয়া হয়েছিলো ওই বছরের অর্থাৎ ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ। সেই থেকে সম্পত্তিটির মালিকানা এবং দখল সরকারেরই। এই সম্পত্তি লিজ দিয়ে জেলা প্রশাসন লিজ মানিও আদায় করে আসছে। সেই সম্পত্তিই এখন হঠাৎ বেদখল হয়ে গেলো।
জেলা প্রশাসনের দুর্বলতা ও কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এভাবে একের পর এক সরকারের অতি মূল্যবান সম্পত্তিগুলো বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তাও একেবারে ডিসি অফিসের নাকের ডগায়-ই।
জালিয়াত চক্র ও সন্ত্রাসীদের হাতে সরকারের মালিকানাধীন অর্পিত সম্পত্তিগুলো একের পর এক বেদখল হওয়া সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য এ প্রতিবেদকের কাছে এসেছে বলে ঢাকা জেলা প্রশাসককে জানানো হলে তিনি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে পরে মতামত দিবেন বলে জানান।
অভিযোগের বিষয়ে আবেদ ও জাবেদের বক্তব্য জানতে বারবার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরো বিস্তারিত পরবর্তীতে আসছে।