জেলা প্রতিনিধি ময়মনসিংহ;
গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে লিমা আক্তার (১৫) নামে এক কিশোরী গৃহকর্মীর শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে। বাদ যায়নি গোপনাঙ্গ ও স্পর্শকাতর স্থান। প্রায়ই লোহার রড দিয়ে তাকে পেটানো হতো। তালা দিয়ে মেরে ভেঙে দেয়া হয়েছে সামনের পাটির একটি দাঁতও।
গত দুই মাস ধরে তার ওপর এমন নির্যাতন চলেছে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট কচুক্ষেত এলাকার চৈতালী ১/ডি ব্লকের সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার বাসায়। অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী নিহত সেনা কর্মকর্তা তানভীরের স্ত্রী মীম।
নির্যাতিতা লীমা হালুয়াঘাট উপজেলার কৈচাপুর ইউনিয়নের দর্শারপাড় গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে। বর্তমানে হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বাবা হাবিবুর রহমানের অভিযোগ, ‘চার মাস আগে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে কাজের কথা বলে লিমাকে ঢাকায় এক আর্মি অফিসারের বাসায় নিয়ে যায় পাশের গ্রামের আছিয়া (জুয়েলের মা)। প্রথম এক দেড়মাস ভালো ভাবেই চলছিল। গত রমজান শুরুর আগে লিমা বাড়ি চলে আসতে চায়। কিন্তু মীম ম্যাডাম কিছুতেই তাকে দিতে রাজি হয়নি ‘
তিনি জানান, ‘সেই থেকে শুরু হয় মেয়ের ওপর অত্যাচার। কারণে-অকারণে নির্যাতন করা হতো মেয়েকে। কাউকে কিছু না জানিয়ে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) হালুয়াঘাটের একটি বাসে করে মেয়েকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তারা। প্রথমে মেয়েকে দেখে আমরা চিনতেই পারিনি। মাথার চুল কাঁটা। সারা শরীরে পোড়া দাগ, আর ঘাঁ। পরে বুধবার মেয়েকে হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি।’
মেয়ের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে তার বিচার চেয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই ঘটনায় থানায় মামলা করব।’
লিমা জানায়, ‘আন্টির বাসায় যাওয়ার পর দুই মাস ভালই ছিলাম। গত রমজান মাস থেকে শুরু হয় মারধর। বাড়ি আসার কথা বললে আরও বেশি করে মারত। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আন্টিকে বলি আমার বেতন দিয়া দেন আমি বাড়িত যামুগা। এমন কথায় সে ইস্ত্রি গরম করে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকা দেয়। তালা দিয়ে মেরে আমার দাঁত ফালাইয়া দিছে, খুন্তি গরম কইরা আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা ছ্যাঁকা দিছে। এমনকি লজ্জার স্থানেও ছ্যাঁকা দেয় আন্টি। আমার মাথা ফাটাইয়া চুল কাইট্টা দেয়। আন্টি মাইর শেষ অইলে তার ছেলে ওয়াদা ও আরেক কাজের মেয়ে পিংকীকে আমাকে মারার জন্য বলত। তারা আমাকে অনেক মারছে। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে আমি বারবার কইতাম আন্টি আমারে কয়ডা বড়ি (ট্যাবলেট) আইন্না দেন আমি আর সহ্য করতে পারতাছি না। আমারে কোনো দিনও একটা বড়িও আইন্না দিছে না। রমজানের ঈদের দিনও আমাকে পেট ভইরা ভাত খাইতে দেয় নাই।’
ঢাকা থেকে কীভাবে বাড়ি এসেছে জানতে চাইলে লিমা জানায়, মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আমার শরীরটা খুব খারাপ ছিল। অনেক কৌশলে বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করি। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তারাই আমাকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের একটি বাসে তুলে দেয়। সেখান থেকে আমি বাড়ি চলে আসি।’
বাড়িতে আসার পর লিমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বুধবার (১০ জুলাই) হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে তার পরিবার।
সেখানে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. মুশফিকা জানান, মেয়েটির গায়ের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। আমরা তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছি।
সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে খবর পেয়ে হালুয়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার বিশ্বাস হাসপাতালে গিয়ে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি জানান, নির্যাতিতা কিশোরীর পরিবার যদি অভিযোগ দেয় পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে গৃহকর্ত্রী মীমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ভাই পরিচয়ে কাজল নামে একজন জানান, মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে ১ বছরের জন্য চুক্তি করে আছিয়ার (জুয়েলের মা) মাধ্যমে এই বাসায় আসে লিমা। আমার বোনের বাসায় ছিল কয়েক মাস। আমাদের এখানে আসার সময়ই দেখেছি তার শরীরে অনেক দাগ ও ঘাঁ। এক মাস কাজ করেই সে চলে যেতে চায়। আমরা বুঝিয়ে এই কয়েক মাস রেখেছি। তার ওপর আমরা কেউ অত্যাচার করিনি। বাড়িতে আসতে না দেয়ায় রাগে নিজের গায়ে নিজেই আঘাত করেছে।
তিনি বলেন, লিমা চলে যেতে চাইলে তার বাবার মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। পরে আমরা বাধ্য হয়ে হালুয়াঘাটের একটি বাসে উঠিয়ে দেই। সে বাস থেকে নেমে বাড়িতে পৌঁছে আমাদের ফোন করে জানায় সে ঠিকমত পৌঁছেছে। এখন শুনি সে হাসপাতালে ভর্তি। এটা আমাদের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।