পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার পানির দরেও কিনছেনা কেউ
- আপডেট সময় : ০৩:০৫:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ ১৮২ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক;
নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আমানতকারীদের পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
যে কারণে, অনেক শেয়ারহোল্ডার পানির দরে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু ক্রেতার অভাবে হতাশ হতে হচ্ছে তাদের। নামমাত্র অর্থে শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব দিয়েও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না শেয়ারহোল্ডাররা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছিল ৩ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে আজ বৃহস্পতিবার লেনদেন শুরুতে ৩০ পয়সা দাম কমে ৩ টাকা ৩০ পয়সা দাঁড়ায়।
তবে প্রথমে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব আসে তিন টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু এ দামে কেউ শেয়ার কিনতে চায়নি। যে কারণে, কয়েক দফা দাম কমে একপর্যায়ে ৩ টাকা ৩০ পয়সা দরে ১ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব আসে। এ দামেও কেউ কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে চায়নি। ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের ক্রেতাশূন্য গেছে।
ফজলুর রহমান নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, পিপলস লিজিং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে সংবাদ এসেছে। এ কারণে কেউ কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে চাচ্ছেন না। শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক শেয়ারবাজারে।
পিপলস লিজিংয়ের কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাকিল রিজভী।
তিনি বলেন, সম্প্রতি শেয়ারবাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার পেছনে পিপলস লিজিংয়ের একটি প্রভাব আছে। এ ছাড়া তারল্য সংকট ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন রাজধানীর মতিঝিল সিটি সেন্টারের পিপলস লিজিংয়ের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন লোক অফিসের সামনে বসে আছেন। রিসিপশনে ছিলেন একজন কর্মী। সামনে সোফায় বসা তিন-চারজন লোক। ভেতরের দরজা বন্ধ। পান্স ছাড়া প্রবেশ করা যায় না। রিসিপশনের লোকটি জানালেন, আজকে কোনো অফিসার নেই। এর বেশি কথা বলা যাবে না। প্রয়োজন হলে পরে আইসেন।
প্রতিষ্ঠানটির এমডি সাহেব আছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার আজকে অফিসে নেই।
এদিকে অফিসে অপেক্ষায় থাকা রশিদ নামের একজন আমানতকারী বলেন, আমাদের একটি সমিতির ৩০ লাখ টাকা পিপলস লিজিংয়ে ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর মধ্যে ছয় মাস পার হয়ে গেছে কিন্তু আমানতের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।
অনেকবার সময় দিয়েছে কিন্তু টাকা দিচ্ছে না। পত্রিকায় দেখলাম, পিপলস লিজিং বন্ধ করে দেয়া হবে। তাহলে আমাদের আমানতের টাকার কী হবে? আমাদের টাকা কীভাবে দেবে। আমরাতো সব নিয়ম মেনেই আমানত রেখেছি। আমাদের কষ্টের টাকা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে যাব।
এ রকম অনেক আমানতকারী পিপলস লিজিংয়ের মতিঝিল অফিসে এসে ভিড় করছেন। এসব বিষয়ে জানার জন্য পিপলস লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হুদার সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ও সরাসরি অফিসে গিয়ে জাগো নিউজের পরিচয়ে কথা বলতে চাইলেও তার দেখা মেলেনি।
পরে জানা গেছে, পিপলস লিজিং অবসায়নের সিন্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ায় ছোট ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী অফিসে আসেন। আবার অনেকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চায়। এ কারণে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সকালে অফিস এসে পরে চলে যান।
এদিকে অনিয়ম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হচ্ছে এ বিষয়টি স্বীকার করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এ সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি শুনেছি। ঠিক আছে কিন্তু এ বিষয়ে না জেনে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিপলস লিজিংয়ে ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সংকটে দুরবস্থায় রয়েছে। তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) এবং ২৯ ধারায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। সম্মতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা আমানতের পরিমাণ, অনিয়মের ধরণ, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ও মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে আমানত রয়েছে দুই হাজার ৮৬ কোটি টাকা। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো কোনো নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে। এ ছাড়া গুলশান ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা রয়েছে। পিপলস লিজিংয়ে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
তাদের মোট শেয়ারের ৬৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের জন্য আদেশ দিতে পারবেন।
একই আইনের ৮ ধারায় যে কোনো আর্থিকপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কারণে যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে, আমাতকারীদের স্বার্থহানি হয় এমনভাবে ব্যবসা করা, দায় পরিশোধে অপর্যাপ্ত সম্পদ, অবসায়ন বা কার্যক্রম বন্ধ, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে কিছু বলা নেই। এ ক্ষেত্রে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, তা কার্যকর হবে। তবে সাধারণভাবে সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হয়।
এ জন্য প্রথমে প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিরূপণ করা হয়। এরপর একটি স্কিম ঘোষণা করা হয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করে কোন পরিমাণ আমানত কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে, তার উল্লেখ থাকে।