ঢাকা ০৩:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo বুড়িচংয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইউএনও’র! Logo ইবি উপাচার্যকে ১০লাখ ঘুষ প্রস্তাব এক তরুনীর! Logo মামলায় জর্জরিত কুলাউড়ার ছাত্রদল নেতা মিতুল পালিয়ে আছেন প্রবাসে Logo ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে শাবি ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু Logo থিয়েটার কুবির ইফতার মাহফিল Logo রাজধানীর শান্তিনগর বাজার নিয়ে শত কোটি টাকার লুটপাট Logo ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের মৃত্যুতে শাবি শিক্ষক সমিতির শোক Logo ঢাবি শিক্ষক ড. জিয়া রহমানের মৃত্যুতে শাবি উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo ময়মনসিংহ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি সজীব, সম্পাদক আশিক Logo পুরান ঢাকায় জুতার কারখানার আগুন




‘উন্নয়ন’ জনগণকে কী দিচ্ছে বা দেবে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৪০:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০১৯ ১০৬ বার পড়া হয়েছে

এ কে এম জাকারিয়া;
উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতার কথা অনেকেই বলেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের। এই সময়ে কোনো প্রকল্প নিয়ে তার পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। তা ছাড়া, এমন অনেক প্রকল্প থাকে, যেগুলো ভবিষ্যতের পরিকল্পিত আরও অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। সরকার বদল হলে আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্প অনেক সময় ঝুলে যায়। এমনকি পরিকল্পনাও বদলে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১০ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেছে। আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। সরকারের মূল স্লোগান হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। এ সময় ঢাকা শহর ও দেশজুড়ে অনেক অবকাঠামো হয়েছে। রাস্তার লেন বাড়ানো, উড়ালসেতু ও সড়ক, নদীর নিচ দিয়ে টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর—এমন আরও প্রকল্প চলমান আছে। মানে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে। কিন্তু এর কী ফল আমরা পাচ্ছি বা পাব?—এ নিয়ে ধাঁধা কিছুই কাটছে না। এসব কি হিসাবনিকাশ করে ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় নেওয়া হচ্ছে? নাকি ‘উন্নয়ন’ করতে হবে, তাই এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে? শুধু অবকাঠামো বানানোই কি উন্নয়ন? নাকি উন্নয়ন বিষয়টি আরও বড়?

ঢাকা শহরের কথাই ধরি। গত ১০ বছরে ঢাকায় দুটি উড়ালসড়ক হয়েছে। অনেক রাস্তা ঢাকা পড়ছে এই উড়ালসড়কের নিচে। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষের চলাচল কি সহজ হয়েছে? পরিসংখ্যান তা বলছে না। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, ১১ বছর আগে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। মানুষ যে গতিতে হাঁটে তা সাধারণভাবে ৫ কিলোমিটার। সরকারের উন্নয়নের হিসাব যা–ই হোক, জনগণ কী পেয়েছে ও পাচ্ছে, এটা হচ্ছে তার হিসাব।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা থাক। মানুষের অভিজ্ঞতা কী বলে? ঢাকা শহরে ১৫ মিনিটের দূরত্ব যেতে কত ঘণ্টা লাগে? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে। সেদিন একজন ফেসবুকে লিখেছেন, চট্টগ্রাম থেকে ১২ ঘণ্টায় ঢাকায় ফিরেছেন। চার লেন হওয়ার আগে কত ঘণ্টা লাগত ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে? অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। সম্ভবত বিদ্যুৎ খাতের ক্ষেত্রেই শুধু বলা যাবে যে জনগণ আগের চেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।

জনগণ যদি ফল না পায় তবে সেই উন্নয়নের অর্থ কী? একটি দেশের পরিবহনব্যবস্থা বা শহর কীভাবে গড়ে ওঠে, এর ব্যবস্থাপনা কীভাবে হয়, নাগরিকদের সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা হয়, কীভাবে পরিকল্পনা করা হয়, তার উদাহরণ বিশ্বের দেশে দেশে রয়েছে। এমনকি একসময়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল এমন নগর বা পরিবহনব্যবস্থাকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায়, বদলে ফেলা যায়, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তার অনেক নজিরও রয়েছে। আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য খুব কাঠখড় পোড়ানোর দরকার নেই। বিভিন্ন মডেল আছে, সঙ্গে মেলে, এমন কোনো মডেল বিবেচনায় নিয়ে এগোলেই হয়। এসব কাজে সময় লাগে, কিন্তু পরিকল্পনাটি ঠিক থাকলে সে অনুযায়ী এগোনো যায়। এই যে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, অবকাঠামো হচ্ছে; এর সঙ্গে সামগ্রিক পরিকল্পনার কোনো সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হয় না। বা আদৌ এমন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা–ও টের পাওয়া যায় না।

মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক হয়েছে। এখন মগবাজার থেকে যাঁরা বাংলামোটরে আসেন, তাঁদের মোড়টি পার হতে কত সময় লাগে? আগের চেয়ে কম না বেশি? ভুক্তভোগীরা তা ভালো জানেন। উড়ালসড়ক হয়েছে, ব্যস। মানে ‘উন্নয়ন’ হয়েছে এবং দায়িত্ব শেষ। লোকজনের সুবিধা আদৌ হলো কি না, তা সম্ভবত বিবেচনার মধ্যেই নেই। বাস্তবে দেখছি উড়ালসড়কের নিচের রাস্তাগুলোকে প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থা। একসময়ের চওড়া রাস্তাগুলো সরু হয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে ময়লা ফেলার ভাগাড়ে। অথবা পড়েছে দখলের কবলে। উড়ালসড়কের নিচের অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে, তা মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে চললে আপনি টের পাবেন। শুধু ময়লা–আবর্জনা নয়, সেখানে রাস্তার মাঝখানে বাজার বসে। সেখানে মোরগ-মুরগি জবাই হয়, চামড়া ছাড়ানো হয়। মাছ বিক্রি হয়, দা-বঁটি দিয়ে মাছের আঁশ ছাড়ানো হয়, কাটা হয়। উড়ালসড়ক তৈরির অর্থ যদি ‘উন্নয়ন’ হয়, তা হলে এর নিচের যে হাল, তাকে আমরা কী বলব? সেখানে তো সর্বনাশ হয়ে গেছে!

শহরের মধ্যে এ ধরনের উড়ালসড়ক বানানো প্রমাণ করে আমাদের পরিকল্পনায় যেমন কোনো আধুনিকতা নেই, তেমনি নেই দূরদৃষ্টি। উন্নত বিশ্বে উড়ালসড়ক মূলত তৈরি হয় কোনো ব্যস্ত শহরে ঢোকার ও বের হওয়ার পথে। যাতে যানবাহন বাধাহীনভাবে শহর থেকে বের হতে বা ঢুকতে পারে। শহরের ভেতরে কোনো রাস্তায় উড়ালসড়ক তৈরির অর্থ সেই রাস্তাটি মেরে ফেলা। আর উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে তার নেই কোনো সমন্বয়। মৌচাক-মগবাজার উড়ালসড়কের কারণে তেজগাঁও-মগবাজার ও রামপুরা মৌচাক রুটের বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাতিল করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তার মানে এই উড়ালসড়কের পরিকল্পনা ও নকশা যখন হয়েছে তখন বিআরটিএর কথা কারও মাথায় ছিল না। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের কারণে মেট্রোরেলকে যাত্রাবাড়ীর পর আর বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না।

উন্নয়ন মানে পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও উন্নয়ন। পরিকল্পনায় যেমন দূরদৃষ্টি থাকতে হয়, ভবিষ্যতের বিবেচনা থাকতে হয়, তেমনি কোন প্রকল্প প্রাধান্য পাবে বা কোনটি পাবে না, তার যৌক্তিক বিচার-বিবেচনাও থাকতে হয়। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প পাস হচ্ছে। অথচ ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা যে খারাপ, তা নজর পায় না কেন? অনেক মেগা প্রকল্পের চেয়ে জনগণের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করার কোনো প্রকল্প বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত কি না, সেই বিবেচনাটি থাকা জরুরি। পলির কারণে পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারযোগ্য রাখা যাবে কি না বা নিয়মিত পলি সরাতে যে অর্থ খরচ করতে হবে, তাতে এই বন্দর চালু রাখা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে এই বন্দর চালু রাখা দুঃসাধ্য হবে। বন্দরের যে অবস্থান, তাতে পলি পড়বেই। একবার পলি ভরাট হলে তা সরাতে লাগবে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর সেই সময় বন্দরটি বন্ধ রাখতে হবে। এই বন্দরের কাজ চলছে কিন্তু এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে। এটা পরিকল্পনা পর্যায়ের সমস্যা। উন্নয়ন নিয়ে আমরা আসলেই বড় ধরনের বিভ্রান্তিতে আছি। বন্দর বানানো আমাদের কাছে উন্নয়ন, কিন্তু এর জন্য যে পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ‘উন্নয়ন’ লাগবে, তা মনে করি না।

শুধু পরিকল্পনা নয়, উন্নয়ন মানে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, শাসন পরিচালনায় উন্নয়ন, আর্থিক ও ব্যাংক খাত পরিচালনায় উন্নয়ন। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একসময়ে বিশ্বমানের ছিল। সেখান থেকে পিছিয়ে গেছে। ব্যাংক খাতে কি আমাদের ‘উন্নয়নের’ দরকার নেই? সেখানে আমরা আগের মান থেকে পিছিয়ে গেলাম কেন? দারিদ্র্য বিমোচনে গতি আগের চেয়ে কমেছে, অসমতাও আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য। ‘উন্নয়ন’ নিশ্চিত করতে হলে এসব ক্ষেত্রেও তো উন্নয়ন দরকার। শুধু কিছু অবকাঠামো বানালেই কি উন্নয়ন হয়ে গেল? উড়ালসড়কের মতো অবকাঠামো হলো কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থাপনা হলো না, এর নিচে ভাগাড় তৈরি হলো বা তা দখল হয়ে গেল—এটা কিসের উন্নয়ন? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হওয়ার পরও ফল মিলছে না ওই ব্যবস্থাপনার সমস্যার কারণে। এই সড়কে উল্টো পথে ট্রাক-বাস চলে, নিয়ম না মেনে যেখানে–সেখানে যানবাহন থামে, বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কে বাজার বসে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্টদের নেই। এই ক্ষেত্রে যদি ‘উন্নয়ন’ না হয় তবে চার লেন কেন ১০ লেন করলেও কোনো লাভ হবে না।

পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন উন্নয়ন নয়, অযৌক্তিক উন্নয়নও উন্নয়ন নয়। কী করতে হবে বা কেন করা হবে, তা পরিকল্পিত ও যৌক্তিক হতে হবে। উন্নয়ন মানে এমন কিছু করা, যাতে জনগণ উপকৃত হয়। শুধু অবকাঠামো তৈরি মানেই উন্নয়ন নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতার দিকে নজর থাকতে হয়। বিবেচনায় রাখতে হয় একটি অবকাঠামো যেন অন্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে অবকাঠামো বোঝায় পরিণত হয়। তাই ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও সমানভাবে জরুরি। উন্নয়নকে সামগ্রিকভাবে না দেখে অবকাঠামো বানানোতে আটকে ফেললে জনগণ তার ফল ভোগ করতে পারবে না।

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপসম্পাদক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




‘উন্নয়ন’ জনগণকে কী দিচ্ছে বা দেবে

আপডেট সময় : ০৮:৪০:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০১৯

এ কে এম জাকারিয়া;
উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতার কথা অনেকেই বলেন। এর পেছনে যুক্তি আছে। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের। এই সময়ে কোনো প্রকল্প নিয়ে তার পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। তা ছাড়া, এমন অনেক প্রকল্প থাকে, যেগুলো ভবিষ্যতের পরিকল্পিত আরও অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। সরকার বদল হলে আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্প অনেক সময় ঝুলে যায়। এমনকি পরিকল্পনাও বদলে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১০ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেছে। আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। সরকারের মূল স্লোগান হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। এ সময় ঢাকা শহর ও দেশজুড়ে অনেক অবকাঠামো হয়েছে। রাস্তার লেন বাড়ানো, উড়ালসেতু ও সড়ক, নদীর নিচ দিয়ে টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর—এমন আরও প্রকল্প চলমান আছে। মানে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে। কিন্তু এর কী ফল আমরা পাচ্ছি বা পাব?—এ নিয়ে ধাঁধা কিছুই কাটছে না। এসব কি হিসাবনিকাশ করে ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় নেওয়া হচ্ছে? নাকি ‘উন্নয়ন’ করতে হবে, তাই এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে? শুধু অবকাঠামো বানানোই কি উন্নয়ন? নাকি উন্নয়ন বিষয়টি আরও বড়?

ঢাকা শহরের কথাই ধরি। গত ১০ বছরে ঢাকায় দুটি উড়ালসড়ক হয়েছে। অনেক রাস্তা ঢাকা পড়ছে এই উড়ালসড়কের নিচে। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষের চলাচল কি সহজ হয়েছে? পরিসংখ্যান তা বলছে না। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, ১১ বছর আগে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। মানুষ যে গতিতে হাঁটে তা সাধারণভাবে ৫ কিলোমিটার। সরকারের উন্নয়নের হিসাব যা–ই হোক, জনগণ কী পেয়েছে ও পাচ্ছে, এটা হচ্ছে তার হিসাব।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা থাক। মানুষের অভিজ্ঞতা কী বলে? ঢাকা শহরে ১৫ মিনিটের দূরত্ব যেতে কত ঘণ্টা লাগে? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হয়েছে। সেদিন একজন ফেসবুকে লিখেছেন, চট্টগ্রাম থেকে ১২ ঘণ্টায় ঢাকায় ফিরেছেন। চার লেন হওয়ার আগে কত ঘণ্টা লাগত ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে? অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। সম্ভবত বিদ্যুৎ খাতের ক্ষেত্রেই শুধু বলা যাবে যে জনগণ আগের চেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।

জনগণ যদি ফল না পায় তবে সেই উন্নয়নের অর্থ কী? একটি দেশের পরিবহনব্যবস্থা বা শহর কীভাবে গড়ে ওঠে, এর ব্যবস্থাপনা কীভাবে হয়, নাগরিকদের সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা হয়, কীভাবে পরিকল্পনা করা হয়, তার উদাহরণ বিশ্বের দেশে দেশে রয়েছে। এমনকি একসময়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল এমন নগর বা পরিবহনব্যবস্থাকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায়, বদলে ফেলা যায়, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তার অনেক নজিরও রয়েছে। আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য খুব কাঠখড় পোড়ানোর দরকার নেই। বিভিন্ন মডেল আছে, সঙ্গে মেলে, এমন কোনো মডেল বিবেচনায় নিয়ে এগোলেই হয়। এসব কাজে সময় লাগে, কিন্তু পরিকল্পনাটি ঠিক থাকলে সে অনুযায়ী এগোনো যায়। এই যে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, অবকাঠামো হচ্ছে; এর সঙ্গে সামগ্রিক পরিকল্পনার কোনো সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হয় না। বা আদৌ এমন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা–ও টের পাওয়া যায় না।

মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক হয়েছে। এখন মগবাজার থেকে যাঁরা বাংলামোটরে আসেন, তাঁদের মোড়টি পার হতে কত সময় লাগে? আগের চেয়ে কম না বেশি? ভুক্তভোগীরা তা ভালো জানেন। উড়ালসড়ক হয়েছে, ব্যস। মানে ‘উন্নয়ন’ হয়েছে এবং দায়িত্ব শেষ। লোকজনের সুবিধা আদৌ হলো কি না, তা সম্ভবত বিবেচনার মধ্যেই নেই। বাস্তবে দেখছি উড়ালসড়কের নিচের রাস্তাগুলোকে প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থা। একসময়ের চওড়া রাস্তাগুলো সরু হয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে ময়লা ফেলার ভাগাড়ে। অথবা পড়েছে দখলের কবলে। উড়ালসড়কের নিচের অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে, তা মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে চললে আপনি টের পাবেন। শুধু ময়লা–আবর্জনা নয়, সেখানে রাস্তার মাঝখানে বাজার বসে। সেখানে মোরগ-মুরগি জবাই হয়, চামড়া ছাড়ানো হয়। মাছ বিক্রি হয়, দা-বঁটি দিয়ে মাছের আঁশ ছাড়ানো হয়, কাটা হয়। উড়ালসড়ক তৈরির অর্থ যদি ‘উন্নয়ন’ হয়, তা হলে এর নিচের যে হাল, তাকে আমরা কী বলব? সেখানে তো সর্বনাশ হয়ে গেছে!

শহরের মধ্যে এ ধরনের উড়ালসড়ক বানানো প্রমাণ করে আমাদের পরিকল্পনায় যেমন কোনো আধুনিকতা নেই, তেমনি নেই দূরদৃষ্টি। উন্নত বিশ্বে উড়ালসড়ক মূলত তৈরি হয় কোনো ব্যস্ত শহরে ঢোকার ও বের হওয়ার পথে। যাতে যানবাহন বাধাহীনভাবে শহর থেকে বের হতে বা ঢুকতে পারে। শহরের ভেতরে কোনো রাস্তায় উড়ালসড়ক তৈরির অর্থ সেই রাস্তাটি মেরে ফেলা। আর উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে তার নেই কোনো সমন্বয়। মৌচাক-মগবাজার উড়ালসড়কের কারণে তেজগাঁও-মগবাজার ও রামপুরা মৌচাক রুটের বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) বাতিল করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তার মানে এই উড়ালসড়কের পরিকল্পনা ও নকশা যখন হয়েছে তখন বিআরটিএর কথা কারও মাথায় ছিল না। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের কারণে মেট্রোরেলকে যাত্রাবাড়ীর পর আর বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না।

উন্নয়ন মানে পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও উন্নয়ন। পরিকল্পনায় যেমন দূরদৃষ্টি থাকতে হয়, ভবিষ্যতের বিবেচনা থাকতে হয়, তেমনি কোন প্রকল্প প্রাধান্য পাবে বা কোনটি পাবে না, তার যৌক্তিক বিচার-বিবেচনাও থাকতে হয়। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প পাস হচ্ছে। অথচ ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা যে খারাপ, তা নজর পায় না কেন? অনেক মেগা প্রকল্পের চেয়ে জনগণের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করার কোনো প্রকল্প বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত কি না, সেই বিবেচনাটি থাকা জরুরি। পলির কারণে পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারযোগ্য রাখা যাবে কি না বা নিয়মিত পলি সরাতে যে অর্থ খরচ করতে হবে, তাতে এই বন্দর চালু রাখা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে এই বন্দর চালু রাখা দুঃসাধ্য হবে। বন্দরের যে অবস্থান, তাতে পলি পড়বেই। একবার পলি ভরাট হলে তা সরাতে লাগবে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর সেই সময় বন্দরটি বন্ধ রাখতে হবে। এই বন্দরের কাজ চলছে কিন্তু এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে। এটা পরিকল্পনা পর্যায়ের সমস্যা। উন্নয়ন নিয়ে আমরা আসলেই বড় ধরনের বিভ্রান্তিতে আছি। বন্দর বানানো আমাদের কাছে উন্নয়ন, কিন্তু এর জন্য যে পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ‘উন্নয়ন’ লাগবে, তা মনে করি না।

শুধু পরিকল্পনা নয়, উন্নয়ন মানে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, শাসন পরিচালনায় উন্নয়ন, আর্থিক ও ব্যাংক খাত পরিচালনায় উন্নয়ন। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একসময়ে বিশ্বমানের ছিল। সেখান থেকে পিছিয়ে গেছে। ব্যাংক খাতে কি আমাদের ‘উন্নয়নের’ দরকার নেই? সেখানে আমরা আগের মান থেকে পিছিয়ে গেলাম কেন? দারিদ্র্য বিমোচনে গতি আগের চেয়ে কমেছে, অসমতাও আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য। ‘উন্নয়ন’ নিশ্চিত করতে হলে এসব ক্ষেত্রেও তো উন্নয়ন দরকার। শুধু কিছু অবকাঠামো বানালেই কি উন্নয়ন হয়ে গেল? উড়ালসড়কের মতো অবকাঠামো হলো কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থাপনা হলো না, এর নিচে ভাগাড় তৈরি হলো বা তা দখল হয়ে গেল—এটা কিসের উন্নয়ন? ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হওয়ার পরও ফল মিলছে না ওই ব্যবস্থাপনার সমস্যার কারণে। এই সড়কে উল্টো পথে ট্রাক-বাস চলে, নিয়ম না মেনে যেখানে–সেখানে যানবাহন থামে, বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কে বাজার বসে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্টদের নেই। এই ক্ষেত্রে যদি ‘উন্নয়ন’ না হয় তবে চার লেন কেন ১০ লেন করলেও কোনো লাভ হবে না।

পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন উন্নয়ন নয়, অযৌক্তিক উন্নয়নও উন্নয়ন নয়। কী করতে হবে বা কেন করা হবে, তা পরিকল্পিত ও যৌক্তিক হতে হবে। উন্নয়ন মানে এমন কিছু করা, যাতে জনগণ উপকৃত হয়। শুধু অবকাঠামো তৈরি মানেই উন্নয়ন নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতার দিকে নজর থাকতে হয়। বিবেচনায় রাখতে হয় একটি অবকাঠামো যেন অন্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে অবকাঠামো বোঝায় পরিণত হয়। তাই ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও সমানভাবে জরুরি। উন্নয়নকে সামগ্রিকভাবে না দেখে অবকাঠামো বানানোতে আটকে ফেললে জনগণ তার ফল ভোগ করতে পারবে না।

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপসম্পাদক