ঢাকা ০৭:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo ইবি উপাচার্যকে ১০লাখ ঘুষ প্রস্তাব এক তরুনীর! Logo মামলায় জর্জরিত কুলাউড়ার ছাত্রদল নেতা মিতুল পালিয়ে আছেন প্রবাসে Logo ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে শাবি ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু Logo থিয়েটার কুবির ইফতার মাহফিল Logo রাজধানীর শান্তিনগর বাজার নিয়ে শত কোটি টাকার লুটপাট Logo ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের মৃত্যুতে শাবি শিক্ষক সমিতির শোক Logo ঢাবি শিক্ষক ড. জিয়া রহমানের মৃত্যুতে শাবি উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo ময়মনসিংহ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি সজীব, সম্পাদক আশিক Logo পুরান ঢাকায় জুতার কারখানার আগুন Logo রাশিয়ায় কনসার্ট হলে বন্দুক হামলার নিহত ৬০, দায় স্বীকার আইএসের




বর্ষায় রাজধানীতে রেকর্ড জলাবদ্ধতার আশংকা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৩৫:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ মে ২০১৯ ১১৯ বার পড়া হয়েছে

হাফিজুর রহমান শফিক;

২০১৭ সালে জলাবদ্ধতার তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজধানীবাসী এখনো ভোলেননি। এবারের বর্ষার মৌসুমে আরও বেশী জলাবদ্ধতার আশংকা। এই ভোগান্তির অবসান ঘটাতে সরকার বারবার প্রত্যয় ব্যাক্ত করলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতি এখনো শেষ হয়নি। ফলে বর্ষা মৌসুম আসার আগেই জলাবদ্ধতার দীর্ঘ ভোগান্তির আশঙ্কায় রাজধানীবাসী।

রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো খনন এবং ভিতরের খালগুলো দখলমুক্ত ও সংস্কার না করা, অধিকাংশ সড়কে মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজে খোঁড়াখুঁড়ির সহ প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলায় ড্রেনের বদ্ধতার করানে এবছর রাজধানীতে রেকর্ড পরিমান জলাবদ্ধতার আশংকা রয়েছে। একই সাথে ঢাকার চারপাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের যে বেহাল দশার কারনে ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবার সামান্য বৃষ্টিপাত এবং নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। আবহাওয়া অধিপ্তর গত মৌসুমের চেয়ে অধিক বৃষ্টিপাতের সম্ভবনার কথাও জানিয়েছে।

সচারচর অল্প বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জমে হাঁটু পানি। আবার কোথাও কোথাও অবাধে নৌকা চলাচল করতেও দেখা যায়। এবারের মৌসুমে ড্রেনে বর্জ্য অবদ্ধতা ও মেট্রো রেলের কাজে অধিকাংশ সড়কের খোঁড়াখুঁড়ির বেহাল চিত্রের কারনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশংকা শতভাগ। আশংকা করা হচ্ছে আসছে মৌসুমে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে এবং পাশাপাশি আশপাশের নদীর পানি বৃদ্ধি হয়ে রাজধানীতে ঢুকে বন্যার কবলে পড়ে রাজধানীবাসী চরম দুর্ভোগে পরতে পারে এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজধানী ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষার প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে বাঁধ নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তার অধিকাংশ জমিই এখনও বেদখলে আছে। আবার সংস্কারের অভাবে পূর্বে নির্মিত বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। ফলে এই বাঁধ রয়েছে ঝুঁকির মুখে। অন্যদিকে, রাজধানীর পূর্বাঞ্চল একেবারেই অরক্ষিত। ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ,বালু এবং শীতলক্ষার পানি বৃদ্ধি হলে যেকোন সময় রাজধানী ঢাকা খুব সহজেই বন্যাকবলিত হয়ে জলাবদ্ধতার স্বীকার হতে পারে বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা আশঙ্কা করছেন।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে মোট ভূমির ১২ শতাংশ জলাধার থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ২ শতাংশ। তাই বৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। অন্যদিকে ঢাকা শহরের ৮০-৯০ ভাগ কংক্রিটে ঢাকা। এতে মাটির নিচে পানি যাওয়ার পথও বন্ধ। আর ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চল ভরাট করায় এর ভেতর থেকে পানি স্বাভাবিকভাবে বের হয় না।এসব কারনেই এমন জলাবদ্ধতা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে, ১৯৮৮ সালের বন্যায় রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হয়। এরপর ঢাকা জেলা রক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই উদ্যোগেই মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন থেকে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হলেও রাজধানী ঢাকায় বন্যার পানি ঢুকতে পারেনি। তবে সংস্কারের অভাবে এসব বাঁধের ১৪ কিলোমিটার জুড়ে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। এতে পুরো বাঁধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো, মাহফুজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫শ ২২ কোটি ৬৪ লাখ ৮৫ টাকার কাজ করেছে। সারাদেশে ৭০টি জোনের মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উপক‚লীয় বাঁধ , ডুবন্ত বাঁধ এবং সেচ খালের বাঁধের মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে। আসলে বরাদ্দ কম থাকার কারণে এ অধিদপ্তরে কাজ করা যাচ্ছে না। গত ২০১৭ সালের মতো বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা হলে এই মৌসুমে আরও বেশী দূর্ভোগে পারতে হবে রাজধানীবাসী।

নগর পরিকল্পনাবীদ ইকবাল হাবিব সকালের সংবাদকে বলেন, যত্রতত্র ফেলায় ড্রেনেজ অবদ্ধতা, বছরজুড়ে রাস্তা খুড়া কুড়ি, রাজধানীর খালগুলোর বেদখল ও খননের ব্যাবস্থা নাকরা, পলিথিন বর্জ্যের অবাধে ব্যবহার রাজধানীর জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দুষনের জন্য দ্বায়ী।
এছাড়াও অনেক প্রকল্পের কাজ চলামান রয়েছে যেমন ওয়াসা, গ্যাস, রাস্তা সংস্কার সহ মেট্রো রেলে প্রকল্পের কাজে সড়কগুলো খোঁড়াখুঁড়ির কারনেও এবছর রাজধানীতে জলাবদ্ধতার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এবং নতুন নতুন নেওয়া প্রকল্প গুলোর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হবে রাজধানীকে।
শুধু বেড়ি বাঁধের কারণেই নয় ঢাকার সিটির পানি বের হওয়ার জন্য সেব খাল ছিল সেগুলো আজ অস্তিত্বহীন। যে কয়টা খালের সামান্য অস্তিত্ব আছে সে গুলোও দখলে দূষনে মৃত প্রায়। ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর অবস্থা। রাজধানী জুড়ে চলছে ড্রেনেজ সংস্কারের কাজ। তবে এগুলো সংস্কার করেও কোন লাভ হয়না। পরিবেশ দূষনের প্রধান বস্তু পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানী সড়কগুলো পানিতে থৈ থৈ করে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন দুই কোটি পলিথিন জমছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিনকে ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য অন্যত্বম কারন হিসেবে চিহ্নিত করেছে পবা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান সকালের সংবাদকে বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয় যেগুলো পলিথিন বর্জ্য। এ বর্জ্য সামান্য বৃষ্টিতে নগরে জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর ২০০২ সালে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ সেই আইন কার্যকর করা যায়নি বলে অভিযোগ করেন অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা সোবহান। ঢাকার অনেকগুলো খাল যেমন দখলে দূষনে বিলিন হয়ে পড়েছে তেমনি এর চার পাশের নদীগুলো এখন মৃত প্রায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা এগুলো নিষ্প্রাণ। দখলে ও বর্জ্য দূষনে এগুলো স্রোতহীন । এ ছাড়া দখলের ফলে বালুনদী এখন প্রায় মৃত। এ সব নদী দিয়ে ঢাকার পানি প্রবাহিত হয়। এসব নদীর প্রবাহ না থাকায় রাজধানীর পানি সহজে বের হতে পারে না। ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫৮টি খাল চিহ্নিত করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। যেকারণে খালগুলোর গতি আর স্বাভাবিক নেই। জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২টি খালের মধ্যে একমাত্র ধোলাইখালের একটা অংশ (সূত্রাপুর লোহারপুল থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত) ও মেরাদিয়া খাল সচল আছে। বাকি সব কটি খালের জায়গায় এখন রাস্তা। প্রতিবেদনে এমনটা বলা হলেও নন্দীপাড়া খাল এখনো সচল আছে। প্রবাহ আছে কুতুবখালী খালেও। যে খালগুলো এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দখল আর ভয়াবহ দূষনের ফলে ঢাকার পানি প্রবাহ মারাত্মক ব্যহত হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায়। পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত সংবাদ মাধ্যমেকে বলেন, আসলে ঢাকাসহ সারাদেশের প্রধান প্রধান নদীর পানির প্রবাহ গতি পথ গুলো সংস্কারের অভাবে দিনের পর দিন ভরাট হয়ে গেছে। কোন সরকার নদী গুলো খনন করার উদ্যোগ না নেয়ার কারণেই রাজধানী জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মুখপাত্র বজলুর রশীদ সকালের সংবাদকে বলেন, গত মৌসুমের চেয়ে এবার বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সম্ভাবনা সত্যি হলে এই বর্ষা মৌসুমে বিগত সব বছরের জলাবদ্ধতার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এবং চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে রাজধানীবাসীকে।
তাই বছরজুড়ে অপরিকল্পিত ভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাস্তা খোড়াখুরি না করে, সঠিক বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা, পলিথিনের অবাধ ব্যাবহার বন্ধ করে রাজধানীর খাল নদী খনন করে গুলোর গতি প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া সহ যুগোপযোগী ড্রেনেজ ব্যাবাস্থা হাতে নিলে রাজধানীবাসী জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করেন অধিকাংশ নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞগন

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




বর্ষায় রাজধানীতে রেকর্ড জলাবদ্ধতার আশংকা

আপডেট সময় : ০৬:৩৫:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ মে ২০১৯

হাফিজুর রহমান শফিক;

২০১৭ সালে জলাবদ্ধতার তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজধানীবাসী এখনো ভোলেননি। এবারের বর্ষার মৌসুমে আরও বেশী জলাবদ্ধতার আশংকা। এই ভোগান্তির অবসান ঘটাতে সরকার বারবার প্রত্যয় ব্যাক্ত করলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতি এখনো শেষ হয়নি। ফলে বর্ষা মৌসুম আসার আগেই জলাবদ্ধতার দীর্ঘ ভোগান্তির আশঙ্কায় রাজধানীবাসী।

রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো খনন এবং ভিতরের খালগুলো দখলমুক্ত ও সংস্কার না করা, অধিকাংশ সড়কে মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজে খোঁড়াখুঁড়ির সহ প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলায় ড্রেনের বদ্ধতার করানে এবছর রাজধানীতে রেকর্ড পরিমান জলাবদ্ধতার আশংকা রয়েছে। একই সাথে ঢাকার চারপাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের যে বেহাল দশার কারনে ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবার সামান্য বৃষ্টিপাত এবং নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। আবহাওয়া অধিপ্তর গত মৌসুমের চেয়ে অধিক বৃষ্টিপাতের সম্ভবনার কথাও জানিয়েছে।

সচারচর অল্প বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জমে হাঁটু পানি। আবার কোথাও কোথাও অবাধে নৌকা চলাচল করতেও দেখা যায়। এবারের মৌসুমে ড্রেনে বর্জ্য অবদ্ধতা ও মেট্রো রেলের কাজে অধিকাংশ সড়কের খোঁড়াখুঁড়ির বেহাল চিত্রের কারনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশংকা শতভাগ। আশংকা করা হচ্ছে আসছে মৌসুমে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে এবং পাশাপাশি আশপাশের নদীর পানি বৃদ্ধি হয়ে রাজধানীতে ঢুকে বন্যার কবলে পড়ে রাজধানীবাসী চরম দুর্ভোগে পরতে পারে এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজধানী ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষার প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে বাঁধ নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তার অধিকাংশ জমিই এখনও বেদখলে আছে। আবার সংস্কারের অভাবে পূর্বে নির্মিত বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। ফলে এই বাঁধ রয়েছে ঝুঁকির মুখে। অন্যদিকে, রাজধানীর পূর্বাঞ্চল একেবারেই অরক্ষিত। ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ,বালু এবং শীতলক্ষার পানি বৃদ্ধি হলে যেকোন সময় রাজধানী ঢাকা খুব সহজেই বন্যাকবলিত হয়ে জলাবদ্ধতার স্বীকার হতে পারে বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা আশঙ্কা করছেন।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে মোট ভূমির ১২ শতাংশ জলাধার থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ২ শতাংশ। তাই বৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। অন্যদিকে ঢাকা শহরের ৮০-৯০ ভাগ কংক্রিটে ঢাকা। এতে মাটির নিচে পানি যাওয়ার পথও বন্ধ। আর ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চল ভরাট করায় এর ভেতর থেকে পানি স্বাভাবিকভাবে বের হয় না।এসব কারনেই এমন জলাবদ্ধতা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে, ১৯৮৮ সালের বন্যায় রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হয়। এরপর ঢাকা জেলা রক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই উদ্যোগেই মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন থেকে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হলেও রাজধানী ঢাকায় বন্যার পানি ঢুকতে পারেনি। তবে সংস্কারের অভাবে এসব বাঁধের ১৪ কিলোমিটার জুড়ে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। এতে পুরো বাঁধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো, মাহফুজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫শ ২২ কোটি ৬৪ লাখ ৮৫ টাকার কাজ করেছে। সারাদেশে ৭০টি জোনের মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উপক‚লীয় বাঁধ , ডুবন্ত বাঁধ এবং সেচ খালের বাঁধের মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে। আসলে বরাদ্দ কম থাকার কারণে এ অধিদপ্তরে কাজ করা যাচ্ছে না। গত ২০১৭ সালের মতো বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা হলে এই মৌসুমে আরও বেশী দূর্ভোগে পারতে হবে রাজধানীবাসী।

নগর পরিকল্পনাবীদ ইকবাল হাবিব সকালের সংবাদকে বলেন, যত্রতত্র ফেলায় ড্রেনেজ অবদ্ধতা, বছরজুড়ে রাস্তা খুড়া কুড়ি, রাজধানীর খালগুলোর বেদখল ও খননের ব্যাবস্থা নাকরা, পলিথিন বর্জ্যের অবাধে ব্যবহার রাজধানীর জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দুষনের জন্য দ্বায়ী।
এছাড়াও অনেক প্রকল্পের কাজ চলামান রয়েছে যেমন ওয়াসা, গ্যাস, রাস্তা সংস্কার সহ মেট্রো রেলে প্রকল্পের কাজে সড়কগুলো খোঁড়াখুঁড়ির কারনেও এবছর রাজধানীতে জলাবদ্ধতার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এবং নতুন নতুন নেওয়া প্রকল্প গুলোর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হবে রাজধানীকে।
শুধু বেড়ি বাঁধের কারণেই নয় ঢাকার সিটির পানি বের হওয়ার জন্য সেব খাল ছিল সেগুলো আজ অস্তিত্বহীন। যে কয়টা খালের সামান্য অস্তিত্ব আছে সে গুলোও দখলে দূষনে মৃত প্রায়। ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর অবস্থা। রাজধানী জুড়ে চলছে ড্রেনেজ সংস্কারের কাজ। তবে এগুলো সংস্কার করেও কোন লাভ হয়না। পরিবেশ দূষনের প্রধান বস্তু পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানী সড়কগুলো পানিতে থৈ থৈ করে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন দুই কোটি পলিথিন জমছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিনকে ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য অন্যত্বম কারন হিসেবে চিহ্নিত করেছে পবা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান সকালের সংবাদকে বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয় যেগুলো পলিথিন বর্জ্য। এ বর্জ্য সামান্য বৃষ্টিতে নগরে জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর ২০০২ সালে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ সেই আইন কার্যকর করা যায়নি বলে অভিযোগ করেন অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা সোবহান। ঢাকার অনেকগুলো খাল যেমন দখলে দূষনে বিলিন হয়ে পড়েছে তেমনি এর চার পাশের নদীগুলো এখন মৃত প্রায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা এগুলো নিষ্প্রাণ। দখলে ও বর্জ্য দূষনে এগুলো স্রোতহীন । এ ছাড়া দখলের ফলে বালুনদী এখন প্রায় মৃত। এ সব নদী দিয়ে ঢাকার পানি প্রবাহিত হয়। এসব নদীর প্রবাহ না থাকায় রাজধানীর পানি সহজে বের হতে পারে না। ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫৮টি খাল চিহ্নিত করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। যেকারণে খালগুলোর গতি আর স্বাভাবিক নেই। জেলা প্রশাসনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২টি খালের মধ্যে একমাত্র ধোলাইখালের একটা অংশ (সূত্রাপুর লোহারপুল থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত) ও মেরাদিয়া খাল সচল আছে। বাকি সব কটি খালের জায়গায় এখন রাস্তা। প্রতিবেদনে এমনটা বলা হলেও নন্দীপাড়া খাল এখনো সচল আছে। প্রবাহ আছে কুতুবখালী খালেও। যে খালগুলো এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দখল আর ভয়াবহ দূষনের ফলে ঢাকার পানি প্রবাহ মারাত্মক ব্যহত হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায়। পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত সংবাদ মাধ্যমেকে বলেন, আসলে ঢাকাসহ সারাদেশের প্রধান প্রধান নদীর পানির প্রবাহ গতি পথ গুলো সংস্কারের অভাবে দিনের পর দিন ভরাট হয়ে গেছে। কোন সরকার নদী গুলো খনন করার উদ্যোগ না নেয়ার কারণেই রাজধানী জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মুখপাত্র বজলুর রশীদ সকালের সংবাদকে বলেন, গত মৌসুমের চেয়ে এবার বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সম্ভাবনা সত্যি হলে এই বর্ষা মৌসুমে বিগত সব বছরের জলাবদ্ধতার রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এবং চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে রাজধানীবাসীকে।
তাই বছরজুড়ে অপরিকল্পিত ভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাস্তা খোড়াখুরি না করে, সঠিক বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা, পলিথিনের অবাধ ব্যাবহার বন্ধ করে রাজধানীর খাল নদী খনন করে গুলোর গতি প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া সহ যুগোপযোগী ড্রেনেজ ব্যাবাস্থা হাতে নিলে রাজধানীবাসী জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করেন অধিকাংশ নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞগন