ঢাকা ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ




লবণ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে গুজব প্রতিরোধ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:০৭:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০১৯ ১১৫ বার পড়া হয়েছে

এইচ আর শফিকঃ  

লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে গুজব ছড়ানোর পর ঢাকার কারওয়ান বাজারে লবণ কিনতে ভিড় করেন ক্রেতারা। লবণের দাম বাড়ছে বলে গৃহকর্মীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে প্রয়োজন না থাকলেও বাজারে ছুটে যান ধানমন্ডির ক্রিসেন্ট রোড এলাকার সৈয়দা ফারজানা জামান, মুদি দোকানগুলোতে লবণ না পেয়ে তিনি পাশের সুপারশপ স্বপ্নতে যান, সেখানেও তিনি লবণ পাননি। ফারজানা লবণ না পেলেও বিকালে একসঙ্গে ২০ কেজি লবণ কিনে হাসিমুখে ঘরে ফিরেছেন নিকুঞ্জের এক গৃহিণী। তার মতো আরও অনেকেই পাঁচ-সাত কেজি করে লবণ কিনেছেন, কোথাও কোথাও ৩৫ টাকার লবণ বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়।

পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে মঙ্গলবার লবণ নিয়ে তুঘলকির এই খবর এসেছে সারা দেশ থেকেই। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে সরকারকে প্রেস নোট দিয়ে বলেছে, বাজারে লবণের সংকট নেই, গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে।

লবণ ব্যবসায়ীরাও পর্যাপ্ত লবণ মজুদ থাকার কথা জানিয়ে বলেছে, সরকারকে বিব্রত করতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

লবণসহ যে কোনো বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ যে কোনো গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার। এদিকে লবণ নিয়ে কারসাজি ঠেকাতে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ।

বাড়তি দামে লবণ বিক্রি করায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক দোকানিকে জেল-জরিমানা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া হয়েছে জনপ্রতি এক কেজি লবণ বিক্রির সীমা।
লবণ নিয়ে যা ঘটল সারা দিন

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর এক লাফে দাম ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১০০ টাকা। এরপর এল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের দাম দুই দিনে উঠে গেল আড়াইশ টাকায়। সরকারের হুঁশিয়ারি আর বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানির খবরে রাতারাতি তা বেশ খানিকটা কমেও গেল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের চেষ্টায় বড় ধরনের ক্ষত থেকে গেল ভোক্তাদের বিশ্বাসে।

সেই টাটকা ক্ষতে লবণ ছিটিয়ে দিল নতুন গুজব, যার পেছনে কোনো চক্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ব্যবসায়ী ও সরকারি দলের অভিযোগ।

লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট, হবিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোণা জেলায় গুজব ছড়ানো হল। তাতে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে গেল, দামও গেল বেড়ে। সকাল হতে হতে সেই গুজব ছড়িয়ে পড়ল ঢাকাসহ সারা দেশে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অধরা বাগচী জানান, বিকালে খুলনার বড় বাজারের দোকানগুলোতে ১০০ টাকা দরে এক কেজি লবণ বিক্রি হয়। “ডাকবাংলো এলাকা থেকে বড় বাজারে লম্বা লাইন লেগে গিয়েছিল। আমি দেখেছি, গুজব রটানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাচ্ছে।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্কুল শিক্ষক আহসানুল হক জানান, দুপুরের পর বিভিন্ন মুদি দোকানে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। “গ্রামের নারীদের বাজারে এসে ২-৫ কেজি পর্যন্ত লবণ কিনতে দেখেছি। আসলে এসব গুজব। অনেকে গুজবকে বিশ্বাস করে বেশি বেশি লবণ কিনেছে, যে কারণে বাজারে লবণের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে লবণের কেজি ২০০ টাকা হয়ে যাবে। এতে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ায় মঙ্গলবার দুপুরের আগে ডিলার ও অনেক পাইকারির ব্যবসায়ীর গুদাম শূন্য হয়ে যায়।

পাইকারি ব্যবসায়ী গনেশ সাহা বলেন, “সকাল থেকেই আমাদের দোকানে লবণ কিনতে সাধারণ মানুষ ও খুচরা বিক্রেতারা ভিড় করে। দুপুর ১২টার মধ্যে আমাদের সমস্ত লবণ বিক্রি হয়ে যায়।।”

কোটালীপাড়ায় লবণ কিনতে আসা এক ভ্যানচালক বলেন, “গতকাল রাতে ঢাকা থেকে আমার এক আত্মীয় ফোন করে বলেছে, লবণের কেজি ২০০ টাকা হবে।”

ক্রেতাদের চাপে ঢাকার অনেক এলাকার দোকান লবণশূন্য হয়ে যায়। বিকালে কারওয়ানবাজারে লবণের জন্য বহু মানুষ ভিড় করলেও তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ।

বিকালে মহাখালী কাচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় প্রতিটি মুদি কোনেই দুই থেকে তিনজন লবণের ক্রেতা রয়েছেন। একেকজন কিনছেন চার থেকে পাঁচ কেজি লবণ। তাদেরই একজন বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা কাতার প্রবাসী নুরু মিয়া।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি এসেছিলাম আইসিডিডিআর,বিতে। আমার মেয়ের কিছু মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট নিতে। বাসা থেকে আমার স্ত্রী ফোন করে বলল, বনশ্রী এলাকার মুদি দোকানগুলোতে লবণ কেনার জন্য সবাই লাইন ধরে আছে। আমার স্ত্রী লাইনে দাঁড়িয়েও লবণ পায়নি। তাই মহাখালী থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছি।“ এই সব আসলে গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। যেভাবে হোক দোকানে যেহেতু লবণ নেই তাই একটু বেশি করে তো কিনতেই হয়।”

মহাখালীর একটি মিনি সুপার শপের পরিচালক মাহবুব আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দিনভর হুজুগে মানুষের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। দিনে যেখানে ১০ কেজি লবণ বিক্রি হয় না, সেখানে এদিন ৭৫ কেজির মতো লবণ কিনে নিয়ে গেছেন লোকজন।

“আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। সেখানে আমার স্ত্রীও গিয়ে বাজার থেকে লবণ কিনেছে কয়েক কেজি। আমি শুনে বলেছি, এখনই এক কেজি রেখে বাকিগুলো ফেরত দিয়ে আস। যে সঙ্কটের কথা শোনা যাচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই।”

মহাখালীর একটি মহল্লার রাস্তা দিয়ে হেঁটে অন্তত পাঁচটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনভর মাত্রাতিরিক্ত বিক্রির কারণে সন্ধ্যা নাগাদ লবণশূন্য হয়ে পড়েছে তারা। একেকটি দোকান থেকে ৬০ থেকে ৭০ কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে।

মিরপুর-১ নম্বরের একজন নারী ক্রেতা বলেন, বিকালে লবণ কিনতে গিয়ে পাননি। ক্রেতা ও দোকানদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, এমনকি মারামারির উপক্রম হতে দেখেছেন তিনি। এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলোতেও লবণ পাওয়া যাচ্ছিল না জানিয়ে ওই এলাকার বাসিন্দা লিজা রহমান বলেন, “খুব কষ্ট করে এক কেজি লবণ পেলাম!”

পাড়া-মহল্লার দোকানে লবণ মিলছে না, সেখানে কারওয়ান বাজারে এসে কয়েক প্যাকেট হাতে আসায় খুশি যেন আর ধরে না।

ক্রেতাদের এই চাপে রাজধানীর পাইকারি বাজারেও লবণের ঘাটতি দেখা দেয় বলে জানান ভাটারার বাসিন্দা মুদি দোকানী শফিক। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “মঙ্গলবার বিকালে নতুনবাজার লবণ কিনতে গিয়ে কোনো দোকানে লবণ পাইনি। লবণ কিনতে আসা লোকজন হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিল।”

মেরুল বাড্ডার দোকানি জুয়েল সরকার বলেন, তার দোকানে যা লবণ ছিল, তা সন্ধ্যার আগেই বিক্রি হয়ে যায়।

তিনি নির্ধারিত দামেই লবণ বিক্রি করেছেন জানিয়ে জুয়েল বলেন, “এলাকার অনেক দোকানে ৫০ টাকা দরে লবণ বিক্রি হচ্ছে বলে আমার দোকানে আসা অনেক ক্রেতা জানিয়েছেন।” মহাখালী কাচা বাজার থেকে ওয়্যারলেসের দিকে ফেরার পথে দেখা হয় জীর্ণ কাপড় পরা ষাটোর্ধ্ব এক নারীর সঙ্গে। এসিআই লবণের এক কেজির তিনটি প্যাকেট কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে অনেকেই তার কাছে লবণের দাম জানতে চাইছিলেন।

এত লবণ কেন কিনেছেন জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, “বাবা রে, আমার বাসায় লবণ বেশি লাগে। আমি সব সময় ৩-৪ প্যাকেটই কিনি। আমি গুজবে কিনি নাই।”

রামপুরা বাজারের মুদি দোকানি নজরুল ইসলাম বলেন, “লবণের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। আমি শুনতেছি লবণের নাকি ঘাটতি দেখা দিয়েছে, কিন্তু লবণ সরবরাহকারী কোনো কোম্পানির লোকই তো এই বিষয়ে আমাদের আগাম কোনো তথ্য দেয়নি। আসলে ঘটনা কী বুঝতে পারছি না।”

লবণ নিয়ে ক্রেতারা বাড়াবাড়ি করেছে মন্তব্য করে মহাখালী মুদি দোকানি হায়দার আলী বলেন, পেঁয়াজের সঙ্কট নিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। এর মধ্যে লবণ সঙ্কটের গুজব খুব সহজেই ‘মার্কেট পেয়েছে’।

“একজন এসে বলল, দুই প্যাকেট লবণ হবে। আমি বললাম হবে একশ টাকা দিতে হবে। ওই লোক সঙ্গে সঙ্গে একশ টাকা বের করে দিল। আমি বললাম, মিয়া পাগল হইছেন? লবণ নিয়ে এত অস্থির হইছেন কেন? তিনি বলেন, ৩-৪ দোকান ঘুরে কোথাও লবণ পাইনি তাই। পরে অবশ্য ওই লোকের কাছ থেকে ৭০ টাকা রেখে বাকি টাকা ফেরত দিয়েছি।”

লবণের দাম বাড়ার খবর সত্যি কি না তা জানতে মঙ্গলবার পুলিশের জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ বহু ফোন এসেছে বলে জানান পুলিশ সদরদপ্তরে এই সেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “সকাল থেকে প্রচুর ফোন এসেছে আমাদের কাছে। এদের সবাই জানতে চাইছে লবণের দাম আসলেই বেড়েছে নাকি গুজব। বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইছে। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বিষয়টি জেনে তাদের জানিয়েছি যে, লবণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।”

লবণ না লাগলেও তিন-চার, এমনকি ২০ কেজিও ঘরে তুলেছেন অনেক গৃহিণী
লবণ না লাগলেও তিন-চার, এমনকি ২০ কেজিও ঘরে তুলেছেন অনেক গৃহিণীস

সরকার পক্ষের বক্তব্যঃ দেশজুড়ে লবণ কেনার হিড়িক এবং অনেক জায়গায় অস্বাভাবিক মূল্য ও লবণ সংকট দেখা দেওয়ার পরে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হয়। পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গুজবে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এতে বলা হয়, “একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণের সঙ্কট রয়েছে মর্মে গুজব রটনা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় লবণের দাম অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।” এরপরেও কাজ না হওয়ায় সন্ধ্যায় প্রেস নোট পাঠায় তথ্য অধিদপ্তর। এতে বলা হয়, দেশে লবণের কোনো সংকট নেই বা এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই।

“লবণ নিয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো ব্যক্তি বা মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনোভাবে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

লবণ নিয়ে কারসাজি দমনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মাঠে নামার কথা জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেন, “তারা বাজার মনিটর করে যাকে জেল দেওয়ার দরকার, তাকে জেল-জরিমানা করবে।”

বর্তমানে দেশে সাড়ে ৬ লাখ টন লবণ মজুদ রয়েছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “এটি একেবারেই একটা অবাস্তব সুযোগ নিচ্ছে শুধুমাত্র একটা গুজব দিয়েই, বাস্তবে এর কোনো কারণ নেই।”

গুজব সরকারকে ‘বিব্রত করতে’ লবণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশের সবচেয়ে বড় দুই ব্র্যান্ড এসিআই ও মোল্লা সল্টের কর্মকর্তারা।

বাস্তবে লবণের কোনো সংকট তৈরি হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোল্লা সল্টের মহাব্যবস্থাক আবদুল মান্নান মঙ্গলবার রাতে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমরা অবাক হয়েছি, কী হচ্ছে দেশে! পেঁয়াজের পর লবণ নিয়ে সরকারকে বিব্রত করতেই সারা দেশে গুজব ছড়ানো হয়েছে।

“এটা খুবই দুঃখজনক। একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে লবণের সংকট দেখা দিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। যার ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশি দামে লবণ বিক্রি হয়েছে। অনেকে দাম আরও বেড়ে যাবে ভেবে বেশি করে কিনেছে।

“আমরা পরিষ্কার করে বলছি, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।”

বাংলাদেশে লবণ বাজারজাতকারী আরেক বড় প্রতিষ্ঠান এসিআই গ্রুপ। এসিআই সল্ট নামে লবণ রয়েছে তাদের।

গুজবে কান দিয়ে বহু মানুষ দোকানে দৌড়ালেও লবণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণের যে মজুদ আছে তাতে সামান্যতম সংকটও হবে না

এসিআই গ্রুপের কনজ্যুমার প্রডাক্টসের পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলেন, “অযথাই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। মানুষকে বোকা বানিয়ে এক শ্রেণির লোক গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি টাকা কামানোর পাঁয়তারা করেছে। “তাড়াতাড়ি লিখে দেন, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত মজুদ আছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।”

বর্তমানে শুধু টেকনাফ থানায় যে পরিমাণ লবণ জমা আছে, তা দিয়ে বাংলাদেশের আগামী ছয় মাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে জানান টেকনাফ থানা লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি মোহাম্মদ হোসাইন।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “গত বছর চাষীরা লবণের দাম না পাওয়ার কারণে বেশিরভাগ চাষী লবণ জমা রেখে দিয়েছেন। এখন নতুন মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু চাষীরা দাম না পাওয়ায় গত বছরের জমানো লবণই বিক্রি করতে পারছে না।

“কারণ এক বছর জমা রাখার পরেও এখন প্রতি মণ লবন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। এক মণ লবণের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০০ টাকা।”

লবণ নিয়ে দেশজুড়ে এই অস্থিরতার মধ্যে সন্ধ্যায় কক্সবাজারের লবণ ব্যবসায়ী ও লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে বসেন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসার।

বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “দেশে লবণের কোনো ধরনের ঘাটতি নেই। চাহিদার অতিরিক্ত মজুদ রয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলসহ দেশে এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে এবং লবণ মিলগুলোতে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে আগামী আরও অন্তত তিন মাসের চাহিদা মেটানো যাবে।”

উৎপাদন মৌসুম শুরুর আগ মুহূর্তে বাজারে ঘাটতির গুজব ছড়ানোকে দেশে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির।

তিনি বলেন, “চলতি মৌসুমে আর এক মাসের মধ্যে প্রায় সব এলাকায় লবণ উৎপাদন শুরু হবে। গত মৌসুমে উৎপাদিত লবণ এখনও মাঠ পর্যায়ে চাষীদের এবং মিল মালিকদের কাছে প্রচুর পরিমাণে মজুদ রয়েছে।

“তাই বাজারে লবণের সংকট হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। মূলত লবণ সংকটের গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারী স্বার্থনেষী মহল বিশেষ দেশে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে।”

ঢাকায় অর্ধশতাধিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
লবণের প্যাকেটের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে বেশি দাম রাখায় ঢাকায় ৭৪ জনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেককে বিভিন্ন অংকের জরিমানা, আবার অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী হাকিম আব্দুল আল মামুন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, নাজিরাবাজার, ধুপখোলা, কাঁচাবাজার, গেন্ডারিয়া ও ওয়ারির বিভিন্ন দোকানে ক্রেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে মোট ১২ জনকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট কাঁচা বাজার এবং টাউন হল বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে লবণের বাড়তি দাম রাখায় পাঁচজনের কাছ থেকে ৫ হাজার করে মোট ২৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয় বলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জিজি বিশ্বাস জানান।

মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজির তার থানা এলাকায় তিনজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করার কথা জানান।

সবুজবাগ থানার ওসি মাহবুব হোসেন বলেন, অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রি করায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার তাদের আদালতে পাঠানো হবে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি শাকির মোহাম্মদ জুবায়ের জানান, নির্বাহী হাকিম কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন দোকানে অভিযান চালিয়ে ১৩ জন ব্যবসায়ীকে তিন হাজার করে ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা করে।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহ জামান তার এলাকার বিভিন্ন দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১৮ দোকানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।

“এর মধ্যে দুইজনকে এক মাস করে কারাদণ্ড, ১১ জনের ৭ দিন করে কারাদণ্ড এবং পাঁচজনকে বিভিন্ন অংকের অর্থদণ্ড করা হয়েছে।”

দক্ষিণখান থানার ওসি শিকদার মো. শামীম হোসেন অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির অভিযোগে দশজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন।

এদের বাইরে নারায়ণগঞ্জ, যশোর ও বগুড়াসহ ১৩ জেলায় অর্ধশতাধিক দোকানিকে জেল-জরিমানার পাশাপাশি অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




লবণ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে গুজব প্রতিরোধ

আপডেট সময় : ০২:০৭:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০১৯

এইচ আর শফিকঃ  

লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে গুজব ছড়ানোর পর ঢাকার কারওয়ান বাজারে লবণ কিনতে ভিড় করেন ক্রেতারা। লবণের দাম বাড়ছে বলে গৃহকর্মীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে প্রয়োজন না থাকলেও বাজারে ছুটে যান ধানমন্ডির ক্রিসেন্ট রোড এলাকার সৈয়দা ফারজানা জামান, মুদি দোকানগুলোতে লবণ না পেয়ে তিনি পাশের সুপারশপ স্বপ্নতে যান, সেখানেও তিনি লবণ পাননি। ফারজানা লবণ না পেলেও বিকালে একসঙ্গে ২০ কেজি লবণ কিনে হাসিমুখে ঘরে ফিরেছেন নিকুঞ্জের এক গৃহিণী। তার মতো আরও অনেকেই পাঁচ-সাত কেজি করে লবণ কিনেছেন, কোথাও কোথাও ৩৫ টাকার লবণ বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়।

পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে মঙ্গলবার লবণ নিয়ে তুঘলকির এই খবর এসেছে সারা দেশ থেকেই। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে সরকারকে প্রেস নোট দিয়ে বলেছে, বাজারে লবণের সংকট নেই, গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে।

লবণ ব্যবসায়ীরাও পর্যাপ্ত লবণ মজুদ থাকার কথা জানিয়ে বলেছে, সরকারকে বিব্রত করতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

লবণসহ যে কোনো বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ যে কোনো গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার। এদিকে লবণ নিয়ে কারসাজি ঠেকাতে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ।

বাড়তি দামে লবণ বিক্রি করায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক দোকানিকে জেল-জরিমানা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া হয়েছে জনপ্রতি এক কেজি লবণ বিক্রির সীমা।
লবণ নিয়ে যা ঘটল সারা দিন

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর এক লাফে দাম ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১০০ টাকা। এরপর এল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের দাম দুই দিনে উঠে গেল আড়াইশ টাকায়। সরকারের হুঁশিয়ারি আর বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানির খবরে রাতারাতি তা বেশ খানিকটা কমেও গেল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের চেষ্টায় বড় ধরনের ক্ষত থেকে গেল ভোক্তাদের বিশ্বাসে।

সেই টাটকা ক্ষতে লবণ ছিটিয়ে দিল নতুন গুজব, যার পেছনে কোনো চক্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ব্যবসায়ী ও সরকারি দলের অভিযোগ।

লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট, হবিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোণা জেলায় গুজব ছড়ানো হল। তাতে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে গেল, দামও গেল বেড়ে। সকাল হতে হতে সেই গুজব ছড়িয়ে পড়ল ঢাকাসহ সারা দেশে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অধরা বাগচী জানান, বিকালে খুলনার বড় বাজারের দোকানগুলোতে ১০০ টাকা দরে এক কেজি লবণ বিক্রি হয়। “ডাকবাংলো এলাকা থেকে বড় বাজারে লম্বা লাইন লেগে গিয়েছিল। আমি দেখেছি, গুজব রটানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাচ্ছে।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্কুল শিক্ষক আহসানুল হক জানান, দুপুরের পর বিভিন্ন মুদি দোকানে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। “গ্রামের নারীদের বাজারে এসে ২-৫ কেজি পর্যন্ত লবণ কিনতে দেখেছি। আসলে এসব গুজব। অনেকে গুজবকে বিশ্বাস করে বেশি বেশি লবণ কিনেছে, যে কারণে বাজারে লবণের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে লবণের কেজি ২০০ টাকা হয়ে যাবে। এতে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ায় মঙ্গলবার দুপুরের আগে ডিলার ও অনেক পাইকারির ব্যবসায়ীর গুদাম শূন্য হয়ে যায়।

পাইকারি ব্যবসায়ী গনেশ সাহা বলেন, “সকাল থেকেই আমাদের দোকানে লবণ কিনতে সাধারণ মানুষ ও খুচরা বিক্রেতারা ভিড় করে। দুপুর ১২টার মধ্যে আমাদের সমস্ত লবণ বিক্রি হয়ে যায়।।”

কোটালীপাড়ায় লবণ কিনতে আসা এক ভ্যানচালক বলেন, “গতকাল রাতে ঢাকা থেকে আমার এক আত্মীয় ফোন করে বলেছে, লবণের কেজি ২০০ টাকা হবে।”

ক্রেতাদের চাপে ঢাকার অনেক এলাকার দোকান লবণশূন্য হয়ে যায়। বিকালে কারওয়ানবাজারে লবণের জন্য বহু মানুষ ভিড় করলেও তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ।

বিকালে মহাখালী কাচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় প্রতিটি মুদি কোনেই দুই থেকে তিনজন লবণের ক্রেতা রয়েছেন। একেকজন কিনছেন চার থেকে পাঁচ কেজি লবণ। তাদেরই একজন বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা কাতার প্রবাসী নুরু মিয়া।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি এসেছিলাম আইসিডিডিআর,বিতে। আমার মেয়ের কিছু মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট নিতে। বাসা থেকে আমার স্ত্রী ফোন করে বলল, বনশ্রী এলাকার মুদি দোকানগুলোতে লবণ কেনার জন্য সবাই লাইন ধরে আছে। আমার স্ত্রী লাইনে দাঁড়িয়েও লবণ পায়নি। তাই মহাখালী থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছি।“ এই সব আসলে গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। যেভাবে হোক দোকানে যেহেতু লবণ নেই তাই একটু বেশি করে তো কিনতেই হয়।”

মহাখালীর একটি মিনি সুপার শপের পরিচালক মাহবুব আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দিনভর হুজুগে মানুষের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। দিনে যেখানে ১০ কেজি লবণ বিক্রি হয় না, সেখানে এদিন ৭৫ কেজির মতো লবণ কিনে নিয়ে গেছেন লোকজন।

“আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। সেখানে আমার স্ত্রীও গিয়ে বাজার থেকে লবণ কিনেছে কয়েক কেজি। আমি শুনে বলেছি, এখনই এক কেজি রেখে বাকিগুলো ফেরত দিয়ে আস। যে সঙ্কটের কথা শোনা যাচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই।”

মহাখালীর একটি মহল্লার রাস্তা দিয়ে হেঁটে অন্তত পাঁচটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনভর মাত্রাতিরিক্ত বিক্রির কারণে সন্ধ্যা নাগাদ লবণশূন্য হয়ে পড়েছে তারা। একেকটি দোকান থেকে ৬০ থেকে ৭০ কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে।

মিরপুর-১ নম্বরের একজন নারী ক্রেতা বলেন, বিকালে লবণ কিনতে গিয়ে পাননি। ক্রেতা ও দোকানদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, এমনকি মারামারির উপক্রম হতে দেখেছেন তিনি। এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলোতেও লবণ পাওয়া যাচ্ছিল না জানিয়ে ওই এলাকার বাসিন্দা লিজা রহমান বলেন, “খুব কষ্ট করে এক কেজি লবণ পেলাম!”

পাড়া-মহল্লার দোকানে লবণ মিলছে না, সেখানে কারওয়ান বাজারে এসে কয়েক প্যাকেট হাতে আসায় খুশি যেন আর ধরে না।

ক্রেতাদের এই চাপে রাজধানীর পাইকারি বাজারেও লবণের ঘাটতি দেখা দেয় বলে জানান ভাটারার বাসিন্দা মুদি দোকানী শফিক। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “মঙ্গলবার বিকালে নতুনবাজার লবণ কিনতে গিয়ে কোনো দোকানে লবণ পাইনি। লবণ কিনতে আসা লোকজন হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিল।”

মেরুল বাড্ডার দোকানি জুয়েল সরকার বলেন, তার দোকানে যা লবণ ছিল, তা সন্ধ্যার আগেই বিক্রি হয়ে যায়।

তিনি নির্ধারিত দামেই লবণ বিক্রি করেছেন জানিয়ে জুয়েল বলেন, “এলাকার অনেক দোকানে ৫০ টাকা দরে লবণ বিক্রি হচ্ছে বলে আমার দোকানে আসা অনেক ক্রেতা জানিয়েছেন।” মহাখালী কাচা বাজার থেকে ওয়্যারলেসের দিকে ফেরার পথে দেখা হয় জীর্ণ কাপড় পরা ষাটোর্ধ্ব এক নারীর সঙ্গে। এসিআই লবণের এক কেজির তিনটি প্যাকেট কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে অনেকেই তার কাছে লবণের দাম জানতে চাইছিলেন।

এত লবণ কেন কিনেছেন জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, “বাবা রে, আমার বাসায় লবণ বেশি লাগে। আমি সব সময় ৩-৪ প্যাকেটই কিনি। আমি গুজবে কিনি নাই।”

রামপুরা বাজারের মুদি দোকানি নজরুল ইসলাম বলেন, “লবণের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। আমি শুনতেছি লবণের নাকি ঘাটতি দেখা দিয়েছে, কিন্তু লবণ সরবরাহকারী কোনো কোম্পানির লোকই তো এই বিষয়ে আমাদের আগাম কোনো তথ্য দেয়নি। আসলে ঘটনা কী বুঝতে পারছি না।”

লবণ নিয়ে ক্রেতারা বাড়াবাড়ি করেছে মন্তব্য করে মহাখালী মুদি দোকানি হায়দার আলী বলেন, পেঁয়াজের সঙ্কট নিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। এর মধ্যে লবণ সঙ্কটের গুজব খুব সহজেই ‘মার্কেট পেয়েছে’।

“একজন এসে বলল, দুই প্যাকেট লবণ হবে। আমি বললাম হবে একশ টাকা দিতে হবে। ওই লোক সঙ্গে সঙ্গে একশ টাকা বের করে দিল। আমি বললাম, মিয়া পাগল হইছেন? লবণ নিয়ে এত অস্থির হইছেন কেন? তিনি বলেন, ৩-৪ দোকান ঘুরে কোথাও লবণ পাইনি তাই। পরে অবশ্য ওই লোকের কাছ থেকে ৭০ টাকা রেখে বাকি টাকা ফেরত দিয়েছি।”

লবণের দাম বাড়ার খবর সত্যি কি না তা জানতে মঙ্গলবার পুলিশের জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ বহু ফোন এসেছে বলে জানান পুলিশ সদরদপ্তরে এই সেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “সকাল থেকে প্রচুর ফোন এসেছে আমাদের কাছে। এদের সবাই জানতে চাইছে লবণের দাম আসলেই বেড়েছে নাকি গুজব। বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইছে। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বিষয়টি জেনে তাদের জানিয়েছি যে, লবণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।”

লবণ না লাগলেও তিন-চার, এমনকি ২০ কেজিও ঘরে তুলেছেন অনেক গৃহিণী
লবণ না লাগলেও তিন-চার, এমনকি ২০ কেজিও ঘরে তুলেছেন অনেক গৃহিণীস

সরকার পক্ষের বক্তব্যঃ দেশজুড়ে লবণ কেনার হিড়িক এবং অনেক জায়গায় অস্বাভাবিক মূল্য ও লবণ সংকট দেখা দেওয়ার পরে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হয়। পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গুজবে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এতে বলা হয়, “একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণের সঙ্কট রয়েছে মর্মে গুজব রটনা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় লবণের দাম অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।” এরপরেও কাজ না হওয়ায় সন্ধ্যায় প্রেস নোট পাঠায় তথ্য অধিদপ্তর। এতে বলা হয়, দেশে লবণের কোনো সংকট নেই বা এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই।

“লবণ নিয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো ব্যক্তি বা মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনোভাবে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

লবণ নিয়ে কারসাজি দমনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মাঠে নামার কথা জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেন, “তারা বাজার মনিটর করে যাকে জেল দেওয়ার দরকার, তাকে জেল-জরিমানা করবে।”

বর্তমানে দেশে সাড়ে ৬ লাখ টন লবণ মজুদ রয়েছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “এটি একেবারেই একটা অবাস্তব সুযোগ নিচ্ছে শুধুমাত্র একটা গুজব দিয়েই, বাস্তবে এর কোনো কারণ নেই।”

গুজব সরকারকে ‘বিব্রত করতে’ লবণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশের সবচেয়ে বড় দুই ব্র্যান্ড এসিআই ও মোল্লা সল্টের কর্মকর্তারা।

বাস্তবে লবণের কোনো সংকট তৈরি হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোল্লা সল্টের মহাব্যবস্থাক আবদুল মান্নান মঙ্গলবার রাতে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমরা অবাক হয়েছি, কী হচ্ছে দেশে! পেঁয়াজের পর লবণ নিয়ে সরকারকে বিব্রত করতেই সারা দেশে গুজব ছড়ানো হয়েছে।

“এটা খুবই দুঃখজনক। একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে লবণের সংকট দেখা দিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। যার ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশি দামে লবণ বিক্রি হয়েছে। অনেকে দাম আরও বেড়ে যাবে ভেবে বেশি করে কিনেছে।

“আমরা পরিষ্কার করে বলছি, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।”

বাংলাদেশে লবণ বাজারজাতকারী আরেক বড় প্রতিষ্ঠান এসিআই গ্রুপ। এসিআই সল্ট নামে লবণ রয়েছে তাদের।

গুজবে কান দিয়ে বহু মানুষ দোকানে দৌড়ালেও লবণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণের যে মজুদ আছে তাতে সামান্যতম সংকটও হবে না

এসিআই গ্রুপের কনজ্যুমার প্রডাক্টসের পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলেন, “অযথাই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। মানুষকে বোকা বানিয়ে এক শ্রেণির লোক গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি টাকা কামানোর পাঁয়তারা করেছে। “তাড়াতাড়ি লিখে দেন, দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত মজুদ আছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।”

বর্তমানে শুধু টেকনাফ থানায় যে পরিমাণ লবণ জমা আছে, তা দিয়ে বাংলাদেশের আগামী ছয় মাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে জানান টেকনাফ থানা লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি মোহাম্মদ হোসাইন।

তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “গত বছর চাষীরা লবণের দাম না পাওয়ার কারণে বেশিরভাগ চাষী লবণ জমা রেখে দিয়েছেন। এখন নতুন মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু চাষীরা দাম না পাওয়ায় গত বছরের জমানো লবণই বিক্রি করতে পারছে না।

“কারণ এক বছর জমা রাখার পরেও এখন প্রতি মণ লবন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। এক মণ লবণের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০০ টাকা।”

লবণ নিয়ে দেশজুড়ে এই অস্থিরতার মধ্যে সন্ধ্যায় কক্সবাজারের লবণ ব্যবসায়ী ও লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে বসেন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসার।

বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “দেশে লবণের কোনো ধরনের ঘাটতি নেই। চাহিদার অতিরিক্ত মজুদ রয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলসহ দেশে এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে এবং লবণ মিলগুলোতে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে আগামী আরও অন্তত তিন মাসের চাহিদা মেটানো যাবে।”

উৎপাদন মৌসুম শুরুর আগ মুহূর্তে বাজারে ঘাটতির গুজব ছড়ানোকে দেশে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির।

তিনি বলেন, “চলতি মৌসুমে আর এক মাসের মধ্যে প্রায় সব এলাকায় লবণ উৎপাদন শুরু হবে। গত মৌসুমে উৎপাদিত লবণ এখনও মাঠ পর্যায়ে চাষীদের এবং মিল মালিকদের কাছে প্রচুর পরিমাণে মজুদ রয়েছে।

“তাই বাজারে লবণের সংকট হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। মূলত লবণ সংকটের গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারী স্বার্থনেষী মহল বিশেষ দেশে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে।”

ঢাকায় অর্ধশতাধিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
লবণের প্যাকেটের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে বেশি দাম রাখায় ঢাকায় ৭৪ জনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেককে বিভিন্ন অংকের জরিমানা, আবার অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী হাকিম আব্দুল আল মামুন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, নাজিরাবাজার, ধুপখোলা, কাঁচাবাজার, গেন্ডারিয়া ও ওয়ারির বিভিন্ন দোকানে ক্রেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে মোট ১২ জনকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট কাঁচা বাজার এবং টাউন হল বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে লবণের বাড়তি দাম রাখায় পাঁচজনের কাছ থেকে ৫ হাজার করে মোট ২৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয় বলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জিজি বিশ্বাস জানান।

মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজির তার থানা এলাকায় তিনজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করার কথা জানান।

সবুজবাগ থানার ওসি মাহবুব হোসেন বলেন, অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রি করায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার তাদের আদালতে পাঠানো হবে।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি শাকির মোহাম্মদ জুবায়ের জানান, নির্বাহী হাকিম কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন দোকানে অভিযান চালিয়ে ১৩ জন ব্যবসায়ীকে তিন হাজার করে ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা করে।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহ জামান তার এলাকার বিভিন্ন দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১৮ দোকানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।

“এর মধ্যে দুইজনকে এক মাস করে কারাদণ্ড, ১১ জনের ৭ দিন করে কারাদণ্ড এবং পাঁচজনকে বিভিন্ন অংকের অর্থদণ্ড করা হয়েছে।”

দক্ষিণখান থানার ওসি শিকদার মো. শামীম হোসেন অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির অভিযোগে দশজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন।

এদের বাইরে নারায়ণগঞ্জ, যশোর ও বগুড়াসহ ১৩ জেলায় অর্ধশতাধিক দোকানিকে জেল-জরিমানার পাশাপাশি অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে।