ঢাকা ০৮:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার! Logo ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোর সংস্কার শুরু Logo বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মানববন্ধন Logo কুবি উপাচার্যের বক্তব্যের প্রমাণ দিতে শিক্ষক সমিতির সাত দিনের আল্টিমেটাম




‘প্রাইভেট’ প্রতারক- ‘ডিটেকটিভ রুদ্র মাহমুদ’! 

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৭:৪১:৩৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ৮৯ বার পড়া হয়েছে

ফেসবুকে ডিটেকটিভ পরিচয়ে কানাডা পাঠানোর ফাঁদ পেতে জালিয়াতি করতেন রুদ্র মাহমুদ

তার ফেসবুক গ্রুপের নাম ‘ডিটেকটিভ রুদ্র মাহমুদ’। প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া আছে একজন মধ্য বয়সী সুদর্শন ব্যক্তির ছবি। কালো রঙের ট্রাউজার আর গেঞ্জি পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র, সেটি আবার শূন্যে তাক করা। এমন দৃশ্য দেখে কারও মনে হতে পারে- সত্যি তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তবে ভার্চুয়াল জগতে এমন পরিচয়ের আড়ালে যে বড় ধরনের ফাঁদ পেতে বসেছেন রুদ্র মাহমুদ পরিচয়ধারী শহিদুল ইসলাম খান ওরফে এস আই খান, তা টের পাননি অনেকেই।

ডিটেকটিভ পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে যে গ্রুপ তৈরি করেছেন, সেখানে নিজেকে কানাডা প্রবাসী দাবি করেন এস আই খান। কানাডায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের করণীয় নিয়ে সেখানে তার নামে একাধিক পোস্ট রয়েছে। তার একটিতে ‘কানাডায় আসার আগে বাস্তবতা জেনে নিন’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপ্রিয় ধনী ও বিরাট দেশ। তবে এ কথাও সত্য যে, এখানে এমন বাস্তবতা আছে, যা আপনি এখানে আসার আগে কল্পনাও করতে পারবেন না। সব জেনে এর মুখোমুখি হলে কষ্ট কম এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত পেশাগত উন্নতি হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কানাডায় যারা থাকি, তারা অধিকাংশ সময় এ ব্যাপারে দেশের লোকদের সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হই। অবশ্য এর অনেক কারণও থাকতে পারে। কেউ যদি তার আত্মীয়স্বজন বা কাছের লোকদের এ বাস্তবতার কথা বলেন, তাহলে তারা ধরে নিতে পারেন তিনি তাদের কানাডায় আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহী করছেন। আবার হয়ত আমরা সঠিক অবস্থাটি বলতে হীনম্মন্যতায় ভুগি। এতে দেশের অনেক ভাইবোন কানাডায় এসে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। না পারেন দেশে ফিরে যেতে, আবার না পারেন এটা সহ্য করতে। তার জীবনটা হয় বিষাদময় আর তিনি নিজের মনেই নিজে বলতে থাকেন- আগে যদি জানতাম! এটা জানানোর জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।’

কানাডায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকেই এস আই খান এসব আর্টিকেল লিখছেন বলে তার গ্রুপে উল্লেখ করেছেন। জরুরি পরামর্শের জন্য বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন। ব্যস্ততার কারণে তিনি কল রিসিভ না করলে ম্যাসেঞ্জারের ইনবক্সে খুদেবার্তা পাঠানোর কথাও জানান। কানাডায় প্রাইভেট ডিটেকটিভের মতো জটিল পেশায় নিয়োজিত থাকায় তার ফোন প্রায় সব সময় ব্যস্ত থাকে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবু বাংলাদেশি যেসব নাগরিক অভিবাসনপ্রত্যাশী, তাদের জন্য তিনি কিছু করার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেসবুক গ্রুপে মোবাইল, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো নম্বর ও কানাডার ঠিকানা দেওয়া আছে।

এস আই খান তার পেজে কানাডায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের টার্গেট করে এভাবেই প্রায় নিয়মিত নানা ধরনের লেখা পোস্ট করতেন। ফেসবুকে তার পোস্ট দেখে কানাডায় যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন অনেকে। মোবাইলে ফোন করে তার সঙ্গে কথাও বলেন কেউ কেউ। পরে এস আই খান বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কানাডার চাকরির ব্যবস্থা ও ভিসা পাইয়ে দিতে সহায়তার কথা জানান। তবে এর বিনিময়ে জনপ্রতি ৪ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত দুই বছরে শুধু কানাডায় নেওয়ার কথা বলে প্রতারণার অভিনব ফাঁদ পেতে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উত্তর বিভাগের হাতে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার হন এস আই খান। অন্যরা হলেন- মো. আবদুল মান্নান, আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান ঢালী। বর্তমানে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এলো এইচএসসি পাস এস আই খান কখনও কানাডায় যাননি। নিজেকে বিভিন্ন সময় মানবাধিকার কর্মী, সিএনএনের বাংলাদেশে প্রতিনিধি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশালের বড় কর্মকর্তা, একাধিক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বার্তা সম্পাদক ও প্রতিরক্ষা বার্তা সংস্থার মহাসচিবসহ নানা ভুয়া পরিচয় দিয়ে চলতেন। এই চক্রকে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে ডিবি কার্যালয়ে গত দু’দিন ভিড় জমাতে থাকেন অসংখ্য ভুক্তভোগী।

এস আই খানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর ধরে ফেসবুকে ভুয়া ডিটেকটিভ পরিচয় দিয়ে একটি গ্রুপ চালান তিনি। টাকার বিনিময়ে দুই ব্যক্তি ওই গ্রুপে কানাডা-সংক্রান্ত বিভিন্ন আর্টিকেল লিখে তার নামে পোস্ট করতেন। এছাড়া কয়েক লাখ ফলোয়ার দেখাতে ‘বুস্ট’ করাতেন তিনি।

রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এস আই খান। কয়েক বছর আগে কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ৮ লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার পর নিজেই প্রতারণায় যুক্ত হন।

এস আই খান বলেন, ‘আমার পরিচয় প্রতারক। তবে যে পথে প্রতারিত হয়েছি, সেই পথে প্রতারণা করে লাখ টাকা আয় করেছি। কখনও ভালো হওয়ার সুযোগ পেলে সুপথে ফিরব।’

এস আই খানের সহযোগী মিজানুর রহমান ঢালী জানান, তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের আবদুল মান্নানের মাধ্যমে এস আই খানের সঙ্গে পরিচয় হয়। যারা কানাডায় অভিবাসনপ্রত্যাশী ছিলেন তাদের সঙ্গে চুক্তি হতো এস আই খানের। তবে তারা কখনও সরাসরি তাকে দেখেননি। তার সঙ্গে মোবাইল বা অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করলে তিনি বলে দিতেন, কার কাছে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। উত্তরায় এপি ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তার কাছে তিনজন ৯ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় দিয়ে যান। তার মধ্যে অর্ধেক টাকা মিজান রেখে বাকিটা এস আই খানকে দিয়েছেন।

প্রতারক চক্রের সদস্য আবদুল মান্নান জানান, তার মেয়ের বিয়েবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ঝামেলা তৈরি হলে এস আই খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। কারণ তার জানা ছিল এস আই খান বড় মানবাধিকার কর্মী। তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। সর্বশেষ বছর দুয়েক আগে কানাডায় ভিসা দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার ফাঁদ তৈরির কথা এস আই খান জানান তাকে। লোভে পড়ে মান্নান ওই পেশায় যুক্ত হন।

প্রতারণার শিকার তারানা হক নামে এক নারী। তার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদরের মঠের বাজার। তিনি সমকালকে জানান, ফেসবুকে কানাডায় যাওয়ার ব্যাপারে ‘রুদ্র মাসুদের’ পোস্ট দেখে বিশ্বাস করেন তিনি। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি পাঠাতে বলেন। এরপর ভিসা প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলে মিজানুর রহমান ঢালীর ঠিকানায় দুই লাখ টাকা ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব নম্বর দিয়ে সেখানে আরও এক লাখ টাকা দিতে বলেন। সেটা পরিশোধ করার পর ‘+১৮০৭৭০০৭৫৫৫৫’ নম্বর থেকে ফোন করে রুদ্র তাকে জানান, একজন সচিবের মাধ্যমে তার ভিসা করা হচ্ছে। সেই সচিব টাকা ছাড়া ভিসা প্রসেস করবেন না। এরপর মিজানুর রহমানের ঢালীর কাছে ওই সচিবের জন্য আরও তিন লাখ টাকা দিতে বলেন রুদ্র।

প্রতারণার শিকার রুম্মান শিকদারের বড় ভাই সৌদি প্রবাসী ফয়সাল শিকদার বলেন, ‘আমার ভাইকে কানাডায় নেওয়ার কথা বলে রুদ্র ও তার সঙ্গীরা সাড়ে ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ঋণ করে ওই টাকা দিয়েছি আমরা। প্রতারণার শিকার হয়ে এখন আমাদের পথে বসার মতো দশা। ভাইয়ের পাসপোর্টে কানাডার ভুয়া ভিসা লাগিয়ে দিয়েছে প্রতারকরা।’

ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা জহির উদ্দিন বলেন, ‘প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আড়াই লাখ টাকা খুইয়েছি আমি। পরে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তারা আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করে। এরপরও কয়েক দফা পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার কথা বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘যারা এই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছে তাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেক পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। সব তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া কখনও কারও সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করা যে কারও জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। অনেকের পাসপোর্ট প্রতারক চক্রের কাছে আটকা ছিল।’

ডিবির উত্তর বিভাগের এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লু বলেন, ‘কথিত রুদ্র মাহমুদ তার ফেসবুক প্রোফাইলে যে ছবি ব্যবহার করেছে সেটি আরেকজনের। সে অত্যন্ত ধূর্ত। তার সঙ্গে কথা বললে যে কারও মনে হবে সে অত্যন্ত শিক্ষিত। বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলত রুদ্র। যাতে অন্য প্রান্তে কানাডার নম্বর দেখা যায়।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




‘প্রাইভেট’ প্রতারক- ‘ডিটেকটিভ রুদ্র মাহমুদ’! 

আপডেট সময় : ০৭:৪১:৩৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ফেসবুকে ডিটেকটিভ পরিচয়ে কানাডা পাঠানোর ফাঁদ পেতে জালিয়াতি করতেন রুদ্র মাহমুদ

তার ফেসবুক গ্রুপের নাম ‘ডিটেকটিভ রুদ্র মাহমুদ’। প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া আছে একজন মধ্য বয়সী সুদর্শন ব্যক্তির ছবি। কালো রঙের ট্রাউজার আর গেঞ্জি পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র, সেটি আবার শূন্যে তাক করা। এমন দৃশ্য দেখে কারও মনে হতে পারে- সত্যি তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তবে ভার্চুয়াল জগতে এমন পরিচয়ের আড়ালে যে বড় ধরনের ফাঁদ পেতে বসেছেন রুদ্র মাহমুদ পরিচয়ধারী শহিদুল ইসলাম খান ওরফে এস আই খান, তা টের পাননি অনেকেই।

ডিটেকটিভ পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে যে গ্রুপ তৈরি করেছেন, সেখানে নিজেকে কানাডা প্রবাসী দাবি করেন এস আই খান। কানাডায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের করণীয় নিয়ে সেখানে তার নামে একাধিক পোস্ট রয়েছে। তার একটিতে ‘কানাডায় আসার আগে বাস্তবতা জেনে নিন’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপ্রিয় ধনী ও বিরাট দেশ। তবে এ কথাও সত্য যে, এখানে এমন বাস্তবতা আছে, যা আপনি এখানে আসার আগে কল্পনাও করতে পারবেন না। সব জেনে এর মুখোমুখি হলে কষ্ট কম এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত পেশাগত উন্নতি হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কানাডায় যারা থাকি, তারা অধিকাংশ সময় এ ব্যাপারে দেশের লোকদের সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হই। অবশ্য এর অনেক কারণও থাকতে পারে। কেউ যদি তার আত্মীয়স্বজন বা কাছের লোকদের এ বাস্তবতার কথা বলেন, তাহলে তারা ধরে নিতে পারেন তিনি তাদের কানাডায় আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহী করছেন। আবার হয়ত আমরা সঠিক অবস্থাটি বলতে হীনম্মন্যতায় ভুগি। এতে দেশের অনেক ভাইবোন কানাডায় এসে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। না পারেন দেশে ফিরে যেতে, আবার না পারেন এটা সহ্য করতে। তার জীবনটা হয় বিষাদময় আর তিনি নিজের মনেই নিজে বলতে থাকেন- আগে যদি জানতাম! এটা জানানোর জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।’

কানাডায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকেই এস আই খান এসব আর্টিকেল লিখছেন বলে তার গ্রুপে উল্লেখ করেছেন। জরুরি পরামর্শের জন্য বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন। ব্যস্ততার কারণে তিনি কল রিসিভ না করলে ম্যাসেঞ্জারের ইনবক্সে খুদেবার্তা পাঠানোর কথাও জানান। কানাডায় প্রাইভেট ডিটেকটিভের মতো জটিল পেশায় নিয়োজিত থাকায় তার ফোন প্রায় সব সময় ব্যস্ত থাকে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবু বাংলাদেশি যেসব নাগরিক অভিবাসনপ্রত্যাশী, তাদের জন্য তিনি কিছু করার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেসবুক গ্রুপে মোবাইল, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো নম্বর ও কানাডার ঠিকানা দেওয়া আছে।

এস আই খান তার পেজে কানাডায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের টার্গেট করে এভাবেই প্রায় নিয়মিত নানা ধরনের লেখা পোস্ট করতেন। ফেসবুকে তার পোস্ট দেখে কানাডায় যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন অনেকে। মোবাইলে ফোন করে তার সঙ্গে কথাও বলেন কেউ কেউ। পরে এস আই খান বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কানাডার চাকরির ব্যবস্থা ও ভিসা পাইয়ে দিতে সহায়তার কথা জানান। তবে এর বিনিময়ে জনপ্রতি ৪ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত দুই বছরে শুধু কানাডায় নেওয়ার কথা বলে প্রতারণার অভিনব ফাঁদ পেতে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উত্তর বিভাগের হাতে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার হন এস আই খান। অন্যরা হলেন- মো. আবদুল মান্নান, আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান ঢালী। বর্তমানে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এলো এইচএসসি পাস এস আই খান কখনও কানাডায় যাননি। নিজেকে বিভিন্ন সময় মানবাধিকার কর্মী, সিএনএনের বাংলাদেশে প্রতিনিধি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশালের বড় কর্মকর্তা, একাধিক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক, আন্তর্জাতিক বার্তা সম্পাদক ও প্রতিরক্ষা বার্তা সংস্থার মহাসচিবসহ নানা ভুয়া পরিচয় দিয়ে চলতেন। এই চক্রকে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে ডিবি কার্যালয়ে গত দু’দিন ভিড় জমাতে থাকেন অসংখ্য ভুক্তভোগী।

এস আই খানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর ধরে ফেসবুকে ভুয়া ডিটেকটিভ পরিচয় দিয়ে একটি গ্রুপ চালান তিনি। টাকার বিনিময়ে দুই ব্যক্তি ওই গ্রুপে কানাডা-সংক্রান্ত বিভিন্ন আর্টিকেল লিখে তার নামে পোস্ট করতেন। এছাড়া কয়েক লাখ ফলোয়ার দেখাতে ‘বুস্ট’ করাতেন তিনি।

রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এস আই খান। কয়েক বছর আগে কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ৮ লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার পর নিজেই প্রতারণায় যুক্ত হন।

এস আই খান বলেন, ‘আমার পরিচয় প্রতারক। তবে যে পথে প্রতারিত হয়েছি, সেই পথে প্রতারণা করে লাখ টাকা আয় করেছি। কখনও ভালো হওয়ার সুযোগ পেলে সুপথে ফিরব।’

এস আই খানের সহযোগী মিজানুর রহমান ঢালী জানান, তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের আবদুল মান্নানের মাধ্যমে এস আই খানের সঙ্গে পরিচয় হয়। যারা কানাডায় অভিবাসনপ্রত্যাশী ছিলেন তাদের সঙ্গে চুক্তি হতো এস আই খানের। তবে তারা কখনও সরাসরি তাকে দেখেননি। তার সঙ্গে মোবাইল বা অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করলে তিনি বলে দিতেন, কার কাছে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। উত্তরায় এপি ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তার কাছে তিনজন ৯ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় দিয়ে যান। তার মধ্যে অর্ধেক টাকা মিজান রেখে বাকিটা এস আই খানকে দিয়েছেন।

প্রতারক চক্রের সদস্য আবদুল মান্নান জানান, তার মেয়ের বিয়েবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ঝামেলা তৈরি হলে এস আই খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। কারণ তার জানা ছিল এস আই খান বড় মানবাধিকার কর্মী। তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। সর্বশেষ বছর দুয়েক আগে কানাডায় ভিসা দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার ফাঁদ তৈরির কথা এস আই খান জানান তাকে। লোভে পড়ে মান্নান ওই পেশায় যুক্ত হন।

প্রতারণার শিকার তারানা হক নামে এক নারী। তার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদরের মঠের বাজার। তিনি সমকালকে জানান, ফেসবুকে কানাডায় যাওয়ার ব্যাপারে ‘রুদ্র মাসুদের’ পোস্ট দেখে বিশ্বাস করেন তিনি। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি পাঠাতে বলেন। এরপর ভিসা প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলে মিজানুর রহমান ঢালীর ঠিকানায় দুই লাখ টাকা ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব নম্বর দিয়ে সেখানে আরও এক লাখ টাকা দিতে বলেন। সেটা পরিশোধ করার পর ‘+১৮০৭৭০০৭৫৫৫৫’ নম্বর থেকে ফোন করে রুদ্র তাকে জানান, একজন সচিবের মাধ্যমে তার ভিসা করা হচ্ছে। সেই সচিব টাকা ছাড়া ভিসা প্রসেস করবেন না। এরপর মিজানুর রহমানের ঢালীর কাছে ওই সচিবের জন্য আরও তিন লাখ টাকা দিতে বলেন রুদ্র।

প্রতারণার শিকার রুম্মান শিকদারের বড় ভাই সৌদি প্রবাসী ফয়সাল শিকদার বলেন, ‘আমার ভাইকে কানাডায় নেওয়ার কথা বলে রুদ্র ও তার সঙ্গীরা সাড়ে ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ঋণ করে ওই টাকা দিয়েছি আমরা। প্রতারণার শিকার হয়ে এখন আমাদের পথে বসার মতো দশা। ভাইয়ের পাসপোর্টে কানাডার ভুয়া ভিসা লাগিয়ে দিয়েছে প্রতারকরা।’

ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা জহির উদ্দিন বলেন, ‘প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আড়াই লাখ টাকা খুইয়েছি আমি। পরে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তারা আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করে। এরপরও কয়েক দফা পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার কথা বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘যারা এই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছে তাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেক পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। সব তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া কখনও কারও সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করা যে কারও জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। অনেকের পাসপোর্ট প্রতারক চক্রের কাছে আটকা ছিল।’

ডিবির উত্তর বিভাগের এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লু বলেন, ‘কথিত রুদ্র মাহমুদ তার ফেসবুক প্রোফাইলে যে ছবি ব্যবহার করেছে সেটি আরেকজনের। সে অত্যন্ত ধূর্ত। তার সঙ্গে কথা বললে যে কারও মনে হবে সে অত্যন্ত শিক্ষিত। বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলত রুদ্র। যাতে অন্য প্রান্তে কানাডার নম্বর দেখা যায়।’