ঢাকা ১১:৩৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo মঙ্গল শোভাযাত্রা – তাসফিয়া ফারহানা ঐশী Logo সাস্টিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ইফতার মাহফিল সম্পন্ন Logo কুবির চট্টগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ইফতার ও পূর্নমিলনী Logo অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমেদের মায়ের মৃত্যুতে শাবির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ পরিষদের শোক প্রকাশ Logo শাবির অধ্যাপক জহীর উদ্দিনের মায়ের মৃত্যুতে উপাচার্যের শোক প্রকাশ Logo বিশ কোটিতে গণপূর্তের প্রধান হওয়ার মিশনে ‘ছাত্রদল ক্যাডার প্রকৌশলী’! Logo দূর্নীতির রাক্ষস ফায়ার সার্ভিসের এডি আনোয়ার! Logo ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোর সংস্কার শুরু Logo বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের মানববন্ধন Logo কুবি উপাচার্যের বক্তব্যের প্রমাণ দিতে শিক্ষক সমিতির সাত দিনের আল্টিমেটাম




ভারত-পাকিস্তান নয়, ক্রিকেটের নতুন উত্তাপ এখন ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৮:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০১৯ ৯৯ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা বার্মিংহ্যাম থেকে:
‘তোমাদের দল তো দারুন খেলছে! এক বিশ্বকাপে তিন তিনবার ৩২০ প্লাস রান করে ফেলেছে। তাও তিন বড় দল দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ৩২০-৩৩০ রান তাড়া করে জিতেও যাচ্ছে। চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এক অন্য মাত্রার দল হয়ে গেছে এখন বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার করা ৩৭০ প্লাস রানের জবাবে যে ব্যাটিংটা করেছে, তা বিশ্বের বেশিরভাগ দলই পারবে না। আরেকটু হিসেব কষে ব্যাট চালালে হয়তো ওইদিন অসিদের রান পাহাড়ও টপকে যেতে পারতো! সত্যিই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দুর্দান্ত খেলছে।’

‘সাকিবতো ফাটিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে আলোচিত পারফরমার। এতকাল জানা ছিল বোলিংয়ের ধার বেশি। এখন তো দেখা যাচ্ছে সাকিবের ব্যাট যেন খোলা তরবারি। সব নামি-দামি আর বাঘা বাঘা বোলাররাও সাকিবের উইলোর দাপটে চুপসে গেছে। মারের তোড়ে লাইন লেন্থ হারিয়ে ফেলছে। সাথে মাশরাফির ‘সেই বোলিংটা’ যদি যোগ হতো, তাহলে নির্ঘাত এতক্ষণে তোমাদের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যেত। আর শেষ দুই ম্যাচের দিকে এভাবে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকতে হতো না।’

ওপরের কথাগুলো ভারতের অন্যতম সিনিয়র ক্রিকেট লেখক, পশ্চিমবঙ্গের নামি ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা আজকালের বিশেষ সংবাদদাতা দেবাশীষ দত্তের।

শুধু দেবাশীষ দত্তই নন। ভারতের অন্যতম নামী ক্রিকেট লেখক, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টার লোকেন্দ্র প্রতাপ শাহী আর দুই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট লেখক গৌতম ভট্টাচার্য্যসহ ভারতীয় ক্রিকেট লেখক এবং রিপোর্টারদের মধ্যে যারা বিশ্বকাপ কাভার করতে এখন বার্মিংহ্যামে, তাদের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগের মুখে টিম বাংলাদেশের অকুণ্ঠ প্রশংসা।

পাশাপাশি টাইগারদের সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়ার ধারনাও পাল্টে গেছে। অনেকের সাথেই কথা বলে জানা হলো, তারা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়েও বরং বাংলাদেশ আর ভারত ম্যাচ উপভোগ করেন এবং বাংলাদেশকে এ মুহূর্তে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সমীহও করেন।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার হয়ে দীর্ঘ তিন যুগের বেশী ক্রিকেট কাভার করা লোকেন্দ্র প্রতাপ শাহীর কথা, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি নানা কারণেই ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ আর মর্যাদার লড়াই হয়ে গেছে। আছে, হয়তো থাকবেও।’ শাহী আরও যোগ করেন, ‘সেটা শুধু খেলার কারণেই নয়। রাজনৈতিক বৈরিতা, পূর্ব শত্রুতা, কাশ্মির ইস্যুসহ নানা ঐতিহাসিক কারণে সেই দেশ বিভাগের পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের শত্রু ভাবাপন্ন মানসিকতাই সেখানে প্রাধান্য পায়।’

সে কারণেই দু’দেশের ক্রিকেট লড়াই মাঠ ছাপিয়ে অন্য মাত্রা পায়। তবে ক্রিকেট লড়াই আর অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বীতার আমেজের কথা চিন্তা করলে এখন বাংলাদেশ আর ভারত ক্রিকেট ম্যাচও পেয়েছে নতুন মাত্রা। এই ম্যাচকে ঘিরে একটা বাড়তি উত্তেজনার বাতাবরণও তৈরি হয়েছে।

গৌতম ভট্টাচার্য আর দেবাশীষ দত্ত অবশ্য এ মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচকেই বেশি আকর্ষণীয়, প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন।

সাথে আলাপে কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য জানালেন এক দারুন তথ্য। তাদের মিডিয়া নয় শুধু, ভারতের ক্রিকেটাররাও এখন বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচকে অধিক আকর্ষণীয়, উপভোগ্য আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ বলে ভাবেন।

তিনি জানালেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটাররা উল্টো আমাদেরকে প্রশ্ন করেন, তোমরা কেন এখনও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে হইচই করো? একটা সময় ছিলো পাক-ভারত ম্যাচ মানেই মারমার কাটকাট অবস্থা। এখন তো আর তা নেই। বরং, বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ হিসেবে আমাদের কাছে দিনকে দিন একটা অন্যরকম জায়গা করে নিচ্ছে। মাঠের পারফরম্যান্সকে মানদণ্ড ধরলে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তানের চেয়ে বরং বাংলাদেশই এখন আমাদের কাছে কঠিন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশ আমাদেরকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছে।’

শনিবার ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগেরদিন এজবাস্টনে একান্ত আলাপে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের এ ফ্রন্টলাইনার বলেই ফেললেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটাররা তো বাংলাদেশ আর ভারত ম্যাচকেই এগিয়ে রাখতে চায়। কারো নাম বলছি না। তবে সংখ্যায় কম নয়। বেশ ক’জন ক্রিকেটার আমাদের বলেছেন, তাদের ভাবনায় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত বেশি স্থান পায়। ভারতীয় ক্রিকেটাররা এ মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ আর ভারত ম্যাচ নিয়ে তারা বেশি ভাবেন। এবং তারা মনে করেন বাংলাদেশের সাথে ভারতের ম্যাচটি অধিক আকর্ষণীয়। এ ম্যাচে উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাও পাক-ভারত লড়াইয়ের চেয়ে বেশি।’

আজকালের বিশেষ সংবাদদাতা দেবাশীষ দত্ততো বলেই দিলেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে তরতরিয়ে এগুচ্ছে, তাতে আগামী ১০ বছর পর এই দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

দেশে বসে বিশ্বাস করা কঠিন । খানিক বিস্ময়কর শোনাবে। কেউ কেউ হয়তো বাড়াবাড়িও ভাববেন; কিন্তু চরম সত্য হলো, ভারত আর ইংল্যান্ডের হাই ভোল্টেজ ম্যাচ বার্মিংহামের এজবাস্টনে। আর বাংলাদেশের সাথে কোহলি , ধোনিদের লড়াই আরও ৭২ ঘন্টা পর ২ জুলাই।

কিন্তু ইংল্যান্ড ছাপিয়ে অনেক বেশি কথা-বার্তা বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ নিয়ে। সবার যত আগ্রহ টাইগারদের নিয়ে। যত প্রশংসাসূচক কথা-বার্তা সাকিব-মুশফিকদের নিয়ে। সেদিন খুব দুরে নয়, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মহা দ্বৈরথ ‘এশেজে’র মত আর ভারত-পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে ম্লান করে ক্রিকেট বিশ্বে আরেকটি লড়াই পাবে ভিন্ন মাত্রা।

অন্যরকম আকর্ষণ আর বাড়তি প্রতিদ্বন্দ্বীতার বাতাবরণে এক নতুন দ্বৈরথ হবে বাংলাদেশ আর ভারতের। টাইগাররা মাঠে সামর্থ্যের সেরাটা উপহার দিতে পারলে, ফিকে হয়ে যাবে পাক-ভারত ম্যাচের আকর্ষণ। কারণ, শক্তিতে এখন আর ভারতের সাথে মোটেই পেরে ওঠে না পাকিস্তানিরা।

সেই ১৯৭৫ সাল থেকে প্রতি চার বছর পরপর মাঠে গড়াচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এর মধ্যে একবারও ভারতের সাথে পারেনি। ৭ বারের মোকাবিলায় প্রতিবার জিতেছে ভারত। এবারের বিশ্বকাপেও ভারতীয়দের দাপটের সামনে দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তানিরা। ডিএল মেথডে হেরেছে ৮৯ রানের বড় ব্যবধানে।

ইতিহাস-পরিসংখ্যান জানাচ্ছে দু’বছর আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের জয়টি ছাড়া পাকিস্তান এখন আর ভারতের সাথে পারে না। জেতা বহুদুরে, প্রতিদ্বন্দ্বীতাও গড়ে তুলতে পারে না। সেখানে বাংলাদেশ দিনকে দিন ভারতের বিপক্ষে মাঠে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

২০০৭ সালে ১০০ কোটি ভারতীয়ের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল টাইগাররা। মাশরাফি, রফিক, রাজ্জাক, তামিম, সাকিব আর মুশফিকদের অবিস্মরণীয় পারফরমেন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোর্ট অফ স্পেনে বাংলাদেশের কাছে ৫ উইকেটে হেরে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে ভারত। ২০১২ সালে এশিয়া কাপেও ভারতকে একই ব্যবধানে হারিয়েছে টাইগাররা।

এরপর কি ওয়ানডে আর কি টি-টোয়েন্টি- দুই ফরম্যাটেই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ ছিল আকর্ষণ আর প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ঠাসা। বেশ কটি ম্যাচ গড়ায় শেষ ওভার পর্যন্ত। এর মধ্যে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ম্যাচটি আম্পায়ার ও থার্ড আম্পায়ারের দুটি ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে উত্তেজনা ছড়ায় প্রচুর। তারপর ২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালোরে বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরের গ্রুপ ম্যাচে ভারতের ওপর বেশিরভাগ সময় প্রভাব বিস্তার করেও শেষ ওভারে গিয়ে দুঃখজনক হেরে যায় বাংলাদেশ।

আর এইতো গত বছর শ্রীলঙ্কার নিদাহাস ট্রফির ফাইনালেও প্রায় জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত দিনেশ কার্তিকের ছক্কায় ভারতকে হারিয়ে কোন টুর্নামেন্ট জেতার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় টাইগারদের।

কিন্তু এটা সত্য, ওই হারগুলোও টিম বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বদলে দিয়েছে। ভারতের কাছে দিনকে দিন কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে টাইগাররা। আর তার সাথে যোগ হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগে ব্যাট করে ৩৩০ রানের হিমালয় সমান ইনিংস গড়ে ২১ রানের জয়। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ৩২১ রান টপকে যাওয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া মাশরাফির দল তাই ভারত ও ভারতীয়দের কাছে অনেক বেশী সমীহর এক দল। কঠিন প্রতিপক্ষ।

২ জুলাই এজবাস্টনে মাশরাফির দল জিতে গেলে সত্যিই ভারত-পাকিস্তানের পাঁচ যুগের বেশি সময়ের চির প্রতিদ্বন্দ্বীতা ঢাকা পড়বে। তার বদলে বাংলাদেশ পরিণত হবে ভারতের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে। টাইগারদের সাথে ভারতীয়দের দ্বৈরথ পাবে অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বীতার মর্যাদা। সবাই বলবে বাংলাদেশ-ভারত মহা দ্বৈরথ।

সেমিফাইনালের লড়াইয়ে টিকে থাকার পাশাপাশি মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম, সৌম্য, লিটন, রিয়াদ (যদি খেলেন), মোসাদ্দেক, মিরাজ, সাইফউদ্দীন আর মোস্তাফিজরা কি নিজেদের সেই নতুন ইমেজ তৈরি করতে পারবেন?

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :




ভারত-পাকিস্তান নয়, ক্রিকেটের নতুন উত্তাপ এখন ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ

আপডেট সময় : ০৮:৫৮:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০১৯

বিশেষ সংবাদদাতা বার্মিংহ্যাম থেকে:
‘তোমাদের দল তো দারুন খেলছে! এক বিশ্বকাপে তিন তিনবার ৩২০ প্লাস রান করে ফেলেছে। তাও তিন বড় দল দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ৩২০-৩৩০ রান তাড়া করে জিতেও যাচ্ছে। চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এক অন্য মাত্রার দল হয়ে গেছে এখন বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার করা ৩৭০ প্লাস রানের জবাবে যে ব্যাটিংটা করেছে, তা বিশ্বের বেশিরভাগ দলই পারবে না। আরেকটু হিসেব কষে ব্যাট চালালে হয়তো ওইদিন অসিদের রান পাহাড়ও টপকে যেতে পারতো! সত্যিই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দুর্দান্ত খেলছে।’

‘সাকিবতো ফাটিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে আলোচিত পারফরমার। এতকাল জানা ছিল বোলিংয়ের ধার বেশি। এখন তো দেখা যাচ্ছে সাকিবের ব্যাট যেন খোলা তরবারি। সব নামি-দামি আর বাঘা বাঘা বোলাররাও সাকিবের উইলোর দাপটে চুপসে গেছে। মারের তোড়ে লাইন লেন্থ হারিয়ে ফেলছে। সাথে মাশরাফির ‘সেই বোলিংটা’ যদি যোগ হতো, তাহলে নির্ঘাত এতক্ষণে তোমাদের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যেত। আর শেষ দুই ম্যাচের দিকে এভাবে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকতে হতো না।’

ওপরের কথাগুলো ভারতের অন্যতম সিনিয়র ক্রিকেট লেখক, পশ্চিমবঙ্গের নামি ও ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা আজকালের বিশেষ সংবাদদাতা দেবাশীষ দত্তের।

শুধু দেবাশীষ দত্তই নন। ভারতের অন্যতম নামী ক্রিকেট লেখক, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টার লোকেন্দ্র প্রতাপ শাহী আর দুই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট লেখক গৌতম ভট্টাচার্য্যসহ ভারতীয় ক্রিকেট লেখক এবং রিপোর্টারদের মধ্যে যারা বিশ্বকাপ কাভার করতে এখন বার্মিংহ্যামে, তাদের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগের মুখে টিম বাংলাদেশের অকুণ্ঠ প্রশংসা।

পাশাপাশি টাইগারদের সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়ার ধারনাও পাল্টে গেছে। অনেকের সাথেই কথা বলে জানা হলো, তারা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়েও বরং বাংলাদেশ আর ভারত ম্যাচ উপভোগ করেন এবং বাংলাদেশকে এ মুহূর্তে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সমীহও করেন।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার হয়ে দীর্ঘ তিন যুগের বেশী ক্রিকেট কাভার করা লোকেন্দ্র প্রতাপ শাহীর কথা, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি নানা কারণেই ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ আর মর্যাদার লড়াই হয়ে গেছে। আছে, হয়তো থাকবেও।’ শাহী আরও যোগ করেন, ‘সেটা শুধু খেলার কারণেই নয়। রাজনৈতিক বৈরিতা, পূর্ব শত্রুতা, কাশ্মির ইস্যুসহ নানা ঐতিহাসিক কারণে সেই দেশ বিভাগের পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের শত্রু ভাবাপন্ন মানসিকতাই সেখানে প্রাধান্য পায়।’

সে কারণেই দু’দেশের ক্রিকেট লড়াই মাঠ ছাপিয়ে অন্য মাত্রা পায়। তবে ক্রিকেট লড়াই আর অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বীতার আমেজের কথা চিন্তা করলে এখন বাংলাদেশ আর ভারত ক্রিকেট ম্যাচও পেয়েছে নতুন মাত্রা। এই ম্যাচকে ঘিরে একটা বাড়তি উত্তেজনার বাতাবরণও তৈরি হয়েছে।

গৌতম ভট্টাচার্য আর দেবাশীষ দত্ত অবশ্য এ মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচকেই বেশি আকর্ষণীয়, প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন।

সাথে আলাপে কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য জানালেন এক দারুন তথ্য। তাদের মিডিয়া নয় শুধু, ভারতের ক্রিকেটাররাও এখন বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচকে অধিক আকর্ষণীয়, উপভোগ্য আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ বলে ভাবেন।

তিনি জানালেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটাররা উল্টো আমাদেরকে প্রশ্ন করেন, তোমরা কেন এখনও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে হইচই করো? একটা সময় ছিলো পাক-ভারত ম্যাচ মানেই মারমার কাটকাট অবস্থা। এখন তো আর তা নেই। বরং, বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ হিসেবে আমাদের কাছে দিনকে দিন একটা অন্যরকম জায়গা করে নিচ্ছে। মাঠের পারফরম্যান্সকে মানদণ্ড ধরলে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তানের চেয়ে বরং বাংলাদেশই এখন আমাদের কাছে কঠিন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশ আমাদেরকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছে।’

শনিবার ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগেরদিন এজবাস্টনে একান্ত আলাপে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের এ ফ্রন্টলাইনার বলেই ফেললেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটাররা তো বাংলাদেশ আর ভারত ম্যাচকেই এগিয়ে রাখতে চায়। কারো নাম বলছি না। তবে সংখ্যায় কম নয়। বেশ ক’জন ক্রিকেটার আমাদের বলেছেন, তাদের ভাবনায় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত বেশি স্থান পায়। ভারতীয় ক্রিকেটাররা এ মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে বাংলাদেশ আর ভারত ম্যাচ নিয়ে তারা বেশি ভাবেন। এবং তারা মনে করেন বাংলাদেশের সাথে ভারতের ম্যাচটি অধিক আকর্ষণীয়। এ ম্যাচে উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাও পাক-ভারত লড়াইয়ের চেয়ে বেশি।’

আজকালের বিশেষ সংবাদদাতা দেবাশীষ দত্ততো বলেই দিলেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে তরতরিয়ে এগুচ্ছে, তাতে আগামী ১০ বছর পর এই দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

দেশে বসে বিশ্বাস করা কঠিন । খানিক বিস্ময়কর শোনাবে। কেউ কেউ হয়তো বাড়াবাড়িও ভাববেন; কিন্তু চরম সত্য হলো, ভারত আর ইংল্যান্ডের হাই ভোল্টেজ ম্যাচ বার্মিংহামের এজবাস্টনে। আর বাংলাদেশের সাথে কোহলি , ধোনিদের লড়াই আরও ৭২ ঘন্টা পর ২ জুলাই।

কিন্তু ইংল্যান্ড ছাপিয়ে অনেক বেশি কথা-বার্তা বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ নিয়ে। সবার যত আগ্রহ টাইগারদের নিয়ে। যত প্রশংসাসূচক কথা-বার্তা সাকিব-মুশফিকদের নিয়ে। সেদিন খুব দুরে নয়, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মহা দ্বৈরথ ‘এশেজে’র মত আর ভারত-পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে ম্লান করে ক্রিকেট বিশ্বে আরেকটি লড়াই পাবে ভিন্ন মাত্রা।

অন্যরকম আকর্ষণ আর বাড়তি প্রতিদ্বন্দ্বীতার বাতাবরণে এক নতুন দ্বৈরথ হবে বাংলাদেশ আর ভারতের। টাইগাররা মাঠে সামর্থ্যের সেরাটা উপহার দিতে পারলে, ফিকে হয়ে যাবে পাক-ভারত ম্যাচের আকর্ষণ। কারণ, শক্তিতে এখন আর ভারতের সাথে মোটেই পেরে ওঠে না পাকিস্তানিরা।

সেই ১৯৭৫ সাল থেকে প্রতি চার বছর পরপর মাঠে গড়াচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এর মধ্যে একবারও ভারতের সাথে পারেনি। ৭ বারের মোকাবিলায় প্রতিবার জিতেছে ভারত। এবারের বিশ্বকাপেও ভারতীয়দের দাপটের সামনে দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তানিরা। ডিএল মেথডে হেরেছে ৮৯ রানের বড় ব্যবধানে।

ইতিহাস-পরিসংখ্যান জানাচ্ছে দু’বছর আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের জয়টি ছাড়া পাকিস্তান এখন আর ভারতের সাথে পারে না। জেতা বহুদুরে, প্রতিদ্বন্দ্বীতাও গড়ে তুলতে পারে না। সেখানে বাংলাদেশ দিনকে দিন ভারতের বিপক্ষে মাঠে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

২০০৭ সালে ১০০ কোটি ভারতীয়ের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল টাইগাররা। মাশরাফি, রফিক, রাজ্জাক, তামিম, সাকিব আর মুশফিকদের অবিস্মরণীয় পারফরমেন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোর্ট অফ স্পেনে বাংলাদেশের কাছে ৫ উইকেটে হেরে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে ভারত। ২০১২ সালে এশিয়া কাপেও ভারতকে একই ব্যবধানে হারিয়েছে টাইগাররা।

এরপর কি ওয়ানডে আর কি টি-টোয়েন্টি- দুই ফরম্যাটেই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ ছিল আকর্ষণ আর প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ঠাসা। বেশ কটি ম্যাচ গড়ায় শেষ ওভার পর্যন্ত। এর মধ্যে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ম্যাচটি আম্পায়ার ও থার্ড আম্পায়ারের দুটি ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে উত্তেজনা ছড়ায় প্রচুর। তারপর ২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালোরে বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরের গ্রুপ ম্যাচে ভারতের ওপর বেশিরভাগ সময় প্রভাব বিস্তার করেও শেষ ওভারে গিয়ে দুঃখজনক হেরে যায় বাংলাদেশ।

আর এইতো গত বছর শ্রীলঙ্কার নিদাহাস ট্রফির ফাইনালেও প্রায় জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত দিনেশ কার্তিকের ছক্কায় ভারতকে হারিয়ে কোন টুর্নামেন্ট জেতার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় টাইগারদের।

কিন্তু এটা সত্য, ওই হারগুলোও টিম বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বদলে দিয়েছে। ভারতের কাছে দিনকে দিন কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে টাইগাররা। আর তার সাথে যোগ হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগে ব্যাট করে ৩৩০ রানের হিমালয় সমান ইনিংস গড়ে ২১ রানের জয়। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ৩২১ রান টপকে যাওয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া মাশরাফির দল তাই ভারত ও ভারতীয়দের কাছে অনেক বেশী সমীহর এক দল। কঠিন প্রতিপক্ষ।

২ জুলাই এজবাস্টনে মাশরাফির দল জিতে গেলে সত্যিই ভারত-পাকিস্তানের পাঁচ যুগের বেশি সময়ের চির প্রতিদ্বন্দ্বীতা ঢাকা পড়বে। তার বদলে বাংলাদেশ পরিণত হবে ভারতের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে। টাইগারদের সাথে ভারতীয়দের দ্বৈরথ পাবে অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বীতার মর্যাদা। সবাই বলবে বাংলাদেশ-ভারত মহা দ্বৈরথ।

সেমিফাইনালের লড়াইয়ে টিকে থাকার পাশাপাশি মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম, সৌম্য, লিটন, রিয়াদ (যদি খেলেন), মোসাদ্দেক, মিরাজ, সাইফউদ্দীন আর মোস্তাফিজরা কি নিজেদের সেই নতুন ইমেজ তৈরি করতে পারবেন?